অলস বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয় না কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক/ বিবিসি বাংলা:
বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয় নিয়ে নানা সমালোচনা থাকলেও, উৎপাদন বন্ধ থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের বিষয়ে তেমন কোন পদক্ষেপ নেই।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সাথে বিভিন্ন সময়ে করা চুক্তি, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বণ্টনের জন্য গ্রিড ব্যবস্থার উন্নয়ন না করা – এমনসব কারণ ছাড়াও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণে এ সমস্যার কোন সমাধান আসছে না।
তবে পাওয়ার সেলের দাবি, দেশে বন্ধ করে দেওয়ার মতো অলস কোন বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই। বরং বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী, যে সক্ষমতা রয়েছে তা থাকাটাই স্বাভাবিক।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ৫ই সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, ২০০৯ সালের পর থেকে ৮২টি বেসরকারি এবং ৩২টি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এক লাখ চার হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিশোধ করেছে।
এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামের তালিকা এবং তাদেরকে দেয়া ক্যাপাসিটি চার্জের তালিকাও সংসদে তুলে ধরেন তিনি।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের যে পরিমাণ ভর্তুকি সরকারকে দিতে হয়, সেটাকেই ক্যাপাসিটি চার্জ বলা হয়।

কীভাবে এই ব্যয় হলো?
চলতি বছরের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি বিভাগের এক গবেষণায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে সমালোচনা করা হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতার মাত্র ৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। বাকী কেন্দ্র অলস থাকে। এর কারণ হলো জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ও কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অত্যধিক বেশি।
এই অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে ব্যয় করতে হয়।
প্রকল্প গ্রহণের আগে ঠিকভাবে যাচাই-বাছাই বা নির্মিত প্ল্যান্টসমূহে জ্বালানি সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হলে বর্তমানে ওইসব কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন হতো না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার যখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সাথে চুক্তি করে তখন সে চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার শর্তটি জুড়ে দেয়া থাকে। এই চার্জ অনেক সময় ডলারে পরিশোধ করা বা ডলারের বিনিময় হার অনুযায়ী পরিশোধ করার মতো শর্তও ছিল। এটি পরিশোধে আইনি বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। এছাড়া ২০১০ সালে দ্রুততম সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি আইন করা হয়েছিল, যে আইন অনুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতের ইউনিট প্রতি দাম ও খরচের মডেল জবাবদিহিতার উর্ধ্বে ছিল। বর্তমানে এ ধরণের শর্ত থাকার কোন যৌক্তিকতা নেই।

প্রতিযোগিতা নেই
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সর্বনিম্ন খরচে বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ না নেয়ার কারণে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বেসরকারি উদ্যোগে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অনেক আগ্রহ দেখা গেছে। দরপত্রের মাধ্যমে বা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সর্বনিম্ন খরচে বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। অথচ সে পথে না গিয়ে সরকার চুক্তির শর্তের মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার শর্তটি বহাল রেখেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন বা সরবরাহ লাইনে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি বলে মনে করেন তিনি।
এ কারণে কিছুদিন আগে পটুয়াখালির বিদ্যুৎকেন্দ্রে সমস্যা হয়েছে এবং রূপপুরেও একই ধরণের সমস্যা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব কারণেই আমাদের অতিরিক্ত ক্যাপাসিটির প্রয়োজন হয়েছে, যা এখন প্রায় ৩৬ শতাংশের মতো এবং ২০২৫ সাল নাগাদ এটা ৫০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশের যে পরিমাণ চাহিদা বেড়েছে, তার সাপেক্ষে যদি সক্ষমতা রাখা হত, তাহলে অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হতো না।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে, পিডিবি, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ, ডেসকোসহ বিভিন্ন সংস্থা ২০১৩ সাল থেকে যে ৬৭টি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে তার অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। ওইসব প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতিকে ‘হতাশাজনক’ বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সুযোগ করে দিয়ে তাদের উৎপাদনে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন সেগুলোর জন্য বাড়তি সক্ষমতা তৈরি হয়েছে এবং ব্যয় বেড়েছে।
ভোক্তা অধিকার বিষয়ক সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ যদি প্রতিযোগিতামূলক হতো তাহলে ক্যাপাসিটি চার্জের মতো খরচের পরিমাণ অনেক কমে আসতো। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে দাম এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যে, প্রথম তিন বছর বা পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের বিনিয়োগ ব্যয় উঠে গেছে। পরবর্তীকালে এই মেয়াদ বৃদ্ধি করে টাকা দেয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে যা বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইন অনুযায়ী, একটা ‘লুণ্ঠন ব্যয়’, অর্থাৎ যে ব্যয়টা যৌক্তিক হয়নি।

কেন বন্ধ হচ্ছে না অব্যবহৃত বিদ্যুৎকেন্দ্র?
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৮ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট। কিন্তু গত ১৯শে এপ্রিল সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সক্ষমতার কথা বলা হচ্ছে সেটা আসলে স্থাপিত ক্ষমতা। এগুলো যত পুরনো হয় ক্ষমতা ততই কমে। বর্তমানে এই সক্ষমতা ২৩ হাজার মেগাওয়াটে নেমে এসেছে। পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই পিডিবির মালিকানাধীন এবং সেগুলোরই সক্ষমতা কমেছে অথবা বন্ধ আছে। এগুলোর সাথে ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়টি প্রযোজ্য নয়। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই চাহিদা বেড়ে গেলে চালু থাকে। ফলে কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র ‘অলস বসে থাকে’ বলার সুযোগ নেই বলে তিনি দাবি করেন।
মহাপরিচালক বলেন, ডিজেল চালিত কিছু কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে সমালোচনা হয়। কিন্তু এগুলো করাই হয়েছে পিক ডিমান্ড বা সর্বোচ্চ চাহিদার সময় সরবরাহ ঠিক রাখতে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রকৃত সক্ষমতার সাথে এর পার্থক্য থাকে সাত হাজার মেগাওয়াটের মতো। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। ভারত বা ইউরোপের মতো দেশে রিজার্ভ মার্জিন ৭০ শতাংশ বা অনেক সময় শতভাগ হয়ে থাকে। কারণ তারা দিনের বেলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চালায়, রাতের বেলা আবার চালু করে। ফলে তাদের ডাবল ক্যাপাসিটি রাখা লাগে। ওইসব চিন্তা করলে আমরা যত সমালোচিত হই, বাস্তবে আমাদের অবস্থা আসলে ওতো খারাপ না। ক্যাপাসিটি চার্জকে ‘বোঝা’ হিসেবে মনে করা হয় ভুল ধারণা থেকে।
মোহম্মদ হোসাইন বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জটা পুরো বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি অংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে দুটি বড় ব্যয় রয়েছে – একটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা জ্বালানির মূল্য এবং অন্যটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়। ক্যাপাসিটি চার্জটা উৎপাদন ব্যয়ের অন্তর্ভূক্ত। পিডিবির ক্ষেত্রে নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্র থাকায় তাদের এই ক্যাপাসিচটি চার্জ হিসাব করা হয় না। তবে বেসরকারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে একজন উদ্যোক্তা সব ব্যয় অন্তর্ভূক্ত করেই হিসাব করে।
ডলারে মূল্য পরিশোধের শর্তের বিষয়ে তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরকে ডলারে পরিশোধ করতেই হয়। বর্তমানে ডলার সংকট যাচ্ছে বলেই এটি সামনে এসেছে। কিন্তু যারা স্থানীয় কোম্পানী এবং যারা স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করে তাদের সাথেও স্থানীয় মুদ্রা এবং ডলার দুটোই ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে কতটুকু স্থানীয় মুদ্রা এবং কতটুকু ডলারে পরিশোধ হবে, তা আইনে বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
ইউনিট প্রতি অত্যধিক দাম নির্ধারণের বিষয়ে বলেন, প্রথম যখন ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয় তখন দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এরপর ২০১০ সালে যখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি নামে আইনটি হয় তখন দরপত্রের মাধ্যমে পাওয়া সর্বনিম্ন দামকে ভিত্তি হিসেবে ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবস্থান কোথায়, ট্রান্সমিশন খরচ কেমন হবে, সেখানকার ভূমির দাম কেমন- সব চুলচেরা বিচার করে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। যত শেষের দিকে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে তার দাম তত কমে এসেছে।