আকাশছোঁয়া এলএনজি’র দাম: শঙ্কায় জ্বালানিখাত
রফিকুল বাসার:
আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি’র দাম বাড়ছে। বাংলাদেশও বেশি দামে কেনা শুরু করেছে। অনেকটা লাফিয়েই বাড়ছে এই দাম। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে দ্বিগুণ। আমদানি শুরুর পর থেকে বাংলাদেশকে এবারই সর্বোচ্চ দামে কিনতে হচ্ছে। এলএনজির সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে তেলসহ জ্বালানির অন্য পণ্যর দামও।
করোনার আগে স্বাভাবিক সময়ে যে দাম ছিল তার থেকেও এখন দাম বাড়তির দিকে।
করোনার কারণে জ্বালানির যে অস্বাভাবিক চাহিদা কমে গিয়েছিল, তা অনেকটাই পূরণ হতে চলেছে। জ্বালানি চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। আর সেই সাথে বাড়ছে দাম। অর্থাৎ ফিরে যাচ্ছে আগের অবস্থানে। কম দামের সুবিধা আর থাকছে না।
ইউরোপ আমেরিকায় করোনার পর অনেকটা স্বাভাবিক হতে চলেছে জীবনযাত্রা। নিয়ন্ত্রিতভাবে সবকিছু খুলে দেয়া হচ্ছে। এশিয়াতে না হলেও ইউরোপে খেলার মাঠে দর্শক। এতে বাড়ছে জ্বালানি চাহিদা। এশিয়ায় ভারত, চীন, জাপানেও গত কয়েকমাস জ্বালানি চাহিদা বাড়ছেই। বাড়ছে অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ের চাহিদায় ফিরে যাচ্ছে।
লকডাউন পরবর্তী চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপি জ্বালানি সরবরাহ ও বাণিজ্য বেড়েছে। আর তাতে দামও বাড়ছে। এশিয়াতে চাহিদা বাড়ায় ইউরোপের বাজারে এলএনজির দাম বেড়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বা খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুমাস আগে যে দামে কেনা হয়েছে তার থেকে এবার দ্বিগুণ দাম দিতে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জির কাছ থেকে ৪৪৮ কোটি ১৬ লাখ ৮২ হাজার টাকায় ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এতে প্রতিহাজার ঘনমিটারের দাম পড়ছে ১৩ ডলার ৪২ সেন্ট।
এপ্রিলে সুইজারল্যান্ডের এওটি ট্রেডিংয়ের কাছ থেকে এই পরিমাণ এলএনজি কিনতে খরচ হয়েছিল ২৪৩ কোটি ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৩৫৮ টাকা। অর্থাৎ এই দুই মাসের ব্যবধানে ২০৪ কোটি ৮৬ লাখ ৪৯ হাজার ৬৪২ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে।
যে গ্যাস এখন প্রায় সাড়ে ১৩ ডলারে কিনতে হচ্ছে তা গতবছর অক্টোবরে কেনা হয়েছিল ৬ ডলারে।
খোলা বাজার থেকে গতবছর, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম এলএনজি আনা হয়।
এলএনজিতে বছরভিত্তিক ভর্তুকি
অর্থবছর টাকার পরিমান
২০১৮-১৯ ১০০০
২০১৯-২০ ২৫০০
২০২০-২১ ২৮১২
মূলতঃ জানুয়ারি থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম বাড়ছে। ফেব্রুয়ারিতে সিঙ্গাপুরের ভিটল এশিয়ার কাছ থেকে কেনা এলএনজির প্রথম কার্গোর ইউনিট প্রতি দাম পড়েছিল ৯ ডলার ৩১ সেন্ট। আর তারপর সপ্তম এলএনজি কার্গোর দাম পড়েছিল ৯ ডলার ৩৬ সেন্ট। দুই কার্গো মিলিয়ে মোট খরচ হয়েছিল ৬২৩ কোটি ৬৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৬৭ টাকা।
এখন বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে।
প্রতিবছর এলএনজিতে ভর্তুকি দ্বিগুণ হচ্ছে। দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হওয়ার পর ২০১৮-১৯ অর্থবছর প্রথমবারের মতো এখাতে এক হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। প্রতি ঘনমিটারে ৫ টাকা ৪৮ পয়সা আয় আর ২ টাকা ২১ পয়সা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর এলএনজি আমদানিতে আড়াই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছর ভর্তুকির পরিমাণ ৩১২ কোটি টাকা বাড়াতে হয়। সম্প্রতি শেষ হওয়া অর্থবছরে এলএনজিতে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ২ হাজার ৮১২ কোটি টাকা।
এলএনজির সাথে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ছে। ব্যারেল প্রতি ৭৫ ডলারের বেশি হয়ে গেছে, যা কিছুদিন আগে ছিল ৭০ ডলারের কম ছিল। দামের পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে ১১০ ডলারে উঠে যেতে পারে। উৎপাদনকারীরা উৎপাদন কমিয়ে দাম বাড়িয়ে দিতে যাচ্ছে।
জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান জানিয়েছেন, এলএনজির দাম এখন এযাবতকালের সর্বোচ্চ। আরও বাড়তে পারে। বিশ্ববাজারে তেলের দামও সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। দাম যে হারে বাড়ছে তাতে আমরা খুবই শঙ্কিত। করোনার মধ্যেই দুই মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ দাম দিয়ে খোলাবাজার থেকে এলএনজি কিনতে হচ্ছে।
এশিয়ায় তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম গত সপ্তাহে ছিল প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) ১৩ ডলারেরও বেশি, যা ২০১৩ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ। মার্কিন বাজারেও দাম বেড়েছে।
বিভিন্ন দেশে চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে দাম বাড়ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, জাপানে একমাসের ব্যবধানে ১৮ শতাংশ চাহিদা বেড়েছে। চাহিদা তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টনে পৌঁছেছে। গরম এবং টোকিও অলিম্পিকের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গতমাসে এলএনজি মজুদ বাড়িয়েছিল জাপান। চীন জুন মাসে প্রায় ৬০ লাখ ৪০ হাজার টন এলএনজি আমদানি করেছে। যা গত বছরের এই সময় থেকে প্র্রায় ২৬ শতাংশ বেশি। শীতের প্রস্তুতির জন্য এখনই চীন প্রচুর আমদানি করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ঠিক রাখতেও তাদের এই উদ্যোগ।
এশীয় খোলাবাজারে এলএনজির সরবরাহ বাড়ায় রফতানিকারীদের অর্থাৎ ইউরোপে কার্গো সংকট দেখা দিয়েছে। এতেও দামে প্রভাব ফেলছে।
খোলাবাজার থেকে দেশে এলএনজি আমদানি করতে আন্তর্জাতিক চার কোম্পানির সাথে চুক্তি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রতিষ্ঠান চারটি হল জাপানের ইটোচু করপোরেশন, সিঙ্গাপুরের গানভোর সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড, যুক্তরাজ্যের টোটাল গ্যাস অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড এবং দুবাইয়ের শেল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং মিডল ইস্ট লিমিটেড।
এলএনজি আমদানির জন্য কাতার ও ওমানের সাথে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আছে। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু চাহিদা পূরণের জন্য এবং দ্রুত সময়ে আনতে নিদির্ষ্ট ঐসব দেশের বাইওে, খোলাবাজার থেকে আমদানির জন্য এই কোম্পানির সাথে চুক্তি করা হয়েছে।
আনিছুর রহমান বলেন, এসব কোম্পানির সাথে চুক্তি করতে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোতি দিয়েছে। কয়েক মাস আগে তারা চুক্তি করতে আবেদন করেছিল।
খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানির জন্য আবেদন আহ্বান করা হলে ২৯টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। তাদের দরপ্রস্তাব প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মূল্যায়ন করে এই চারটি কোম্পানি ঠিক করা হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানি করতে কাতার এবং ওমানের সাথে চুক্তি আছে। কাতারের সাথে ১৫ বছরের চুক্তি হয়েছে। প্রতিবছর কাতার থেকে ১০ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২০ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন এলএনজি আমদানি করা যাবে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে কাতার থেকে প্রথম এলএনজি আনা হয়। এরপর ২০১৯ সালে ৪৩টি এবং ২০২০ সালে ৪০টি কার্গোতে এলএনজি আসে। ২০২১ সালে ৪০টি কার্গো আসার কথা। অন্যদিকে ওমানের সাথে ১০ বছরের চুক্তি হয়েছে। বছরে ১০ লাখ থেকে ১০ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিকটন আনা যাবে। ওমান থেকে ২০১৯ সালে ২০টি এবং ২০২০ সালে ২৬টি কার্গোতে এলএনজি আসে। ২০২১ সালে আসার কথা ২৪টি কার্গো।
২০১৮ সালের ২৫শে এপ্রিলে দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। সামিট এলএনজি ও যুক্তরাষ্ট্রের এক্সেলারেট এনার্জির স্থাপন করা ভাসমান টার্মিনালের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে আমদানি করা এলএনজি জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিটি এফএসআরইউর সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট। এই ক্ষমতা আরও বাড়ানো হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও ৪ঠা আগষ্ট জাতীয় গ্রিডে আমদানি করা এলএনজি থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ৭০ কোটি ১৩ লাখ ঘনফুট। যা গত মাসের চেয়ে কম। একমাস আগে ৪ঠা জুলাই জাতীয় গ্রিডে এলএনজি থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হয়ে ছিল ৭৫ কোটি ১৪ লাখ ঘনফুট।
তবে এই সময় দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। দেশীয় ক্ষেত্রগুলো থেকে ৪ঠা আগষ্ট জাতীয় গ্রিডে ৩০৩ কোটি ৪০ লাখ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। গতমাসের একই তারিখে এই সরবরাহ ছিল ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট গ্যাস। গত ডিসেম্বরে এলএনজি সরবরাহ ছিল প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট।