আজ মহান বিজয় দিবস

আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন একটি পতাকার জন্ম হয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সেই পতাকার জন্ম দেয় বীর বাঙ্গালী।
কয়েকশ’ বছরের বিজাতীয় শাসন-শোষণের জগদ্দল পাথর সরিয়ে মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল একাত্তরের এদিন। একাত্তরের মার্চ মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আজকের দিনে পাকবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলার দামাল ছেলেরা।
যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকায় প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হয়েছে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন।
সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, সশস্ত্রবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ করেছে।

দিনটি সরকারি ছুটির দিন। সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপে জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সজ্জিত করা হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা বাণী দিয়ে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে এবং টেলিভিশনগুলো  মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচার করছে।
১৯৪৭ সালে দুইশ’ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে এ অঞ্চলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান নামে একটি সামপ্রদায়িক রাষ্ট্র। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিশাল ভূখণ্ডের ব্যবধান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান সত্যিকারের স্বাধীনতা বঞ্চিত হয়ে রইল। পশ্চিম পাকিস্তান এদেশে শোষণ চালাতে থাকে। তারা বাঙালি গণমানুষের ভাষা সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য ধ্বংস করার জন্য সুপরিকল্পিত চক্রান্ত করে। এতে বাঙালি জাতি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তানের সব অনাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। এভাবে ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ‘৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৮-৬৯’র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধের পথ ধরে ঊনসত্তরে বীর বাঙালি জাতি ফুঁসে ওঠে। আন্দোলনের পথ বেয়ে পাকিস্তানি শাসকরা বাধ্য হয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন দিতে। ১৯৭০ সালে দেশে প্রথম অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এ ভূখণ্ডের এবং বাঙালি গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও দেশ পরিচালনার ভার বঙ্গবন্ধুর হাতে না দিয়ে পাকিস্তানি শাসক চক্র বিভিন্ন রকম চক্রান্তে মেতে ওঠে।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হলেও পরে তা স্থগিত করে দেয় পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া। এর ফলে বাঙালি প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে। রাজপথে সেস্নাগান ওঠে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। একাত্তরের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শুরু হয় সারাদেশে গণমানুষের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। এরপর সামরিক চক্র আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকে বাংলাদেশে। ২৫ মার্চ বর্বর পাকবাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর সামরিক শাসকচক্র তাকে গ্রেফতার করলে তার অনুপস্থিতিতেই তার নির্দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় গঠিত হয় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার। এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত করতে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি গ্রামে। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের পর বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। ‘৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে পাকসেনা কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন।