আদানি গ্রুপের সাথে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি পুনর্বিবেচনা দরকার কেন?
মুন্নী আক্তার:
ভারতের আদানি গ্রুপের সাথে করা বহুল আলোচিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির শর্ত পুনর্বিবেচনার করার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড যে চিঠি দিয়েছিল তা নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে।
এ বিষয়ে আদানী গ্রুপ থেকে একটি প্রতিনিধিদল এ মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন।
মি. হোসাইন বলেন, “তখন হয়তো সামনাসামনি আলোচনা হবে আরকি… আমার মনে হয় সেটাই উইল বি দ্যা বেস্ট অপশন টু নেগোশিয়েট টু ইচ আদার(পরস্পরের সাথে সমঝোতার সেটাই হবে সবচেয়ে ভালো উপায়।)”
এরইমধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কুমার কোয়াত্রা বাংলাদেশ সফর করে চলে গেলেও আদানি গ্রুপের সাথে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি বলে জানা গেছে।
তবে গত ৭ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ভারতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে আদানি পাওয়ার জানিয়েছে যে, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে কোন সমঝোতা হচ্ছে না। আদানির মুখপাত্র ভারশা চাইনাই এর উদ্ধৃতি দিয়ে এমন খবর দেয়া হয়।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, এই চুক্তিটি নিয়ে কোন সমঝোতা না হলে আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনাটা বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটা হবে কিনা?
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা হলে তার দাম অনেক বেশি পড়বে। কারণ আদানি গ্রুপ কয়লার দাম ধরেছে চারশ ডলার প্রতি টন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে কয়লার দাম প্রতি টন আড়াইশ ডলারের মতো।
জ্বালানির দাম এমন ধরা হলে বিদ্যুতের জন্য বাড়তি দাম দিতে হবে যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে করেন তিনি। কারণ ভবিষ্যতে তাহলে খুচরা পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে।
“প্রেজেন্ট ডিলে যে শর্তগুলো আছে তাতে বাংলাদেশ গেলে ‘ইট উইল নট বি প্রফিটেবল’ বাংলাদেশের জন্য,” বলেন তিনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম তামিম বলেন, আদানি থেকে যে বিদ্যুৎ কেনা হবে সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের তুলনায় এক বা দেড় টাকা ইউনিট প্রতি বেশি হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ ১৩-১৪ টাকা দাম সেটা যদি ২২টাকায় কিনতে হয় তাহলে সেটা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকারক।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আদানি গ্রুপের সাথে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিটি একদিকে ভাল।
তার মতে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দিক থেকে সফল হলেও এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি যোগান দেয়ার বিষয়ে ব্যর্থ হয়েছে। যা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা গেছে কোভিড মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের সময়।
সেদিক থেকে আদানি গ্রুপের সাথে চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং জ্বালানির যোগান দুটোই তারাই দিচ্ছে।
তবে সমস্যাটা হয়েছে, যে সময়ে এই চুক্তিটি করা হয়েছিল তখন পরিস্থিতি এখনকার মতো ছিল না। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী ছিল না। তাই বিশেষ পরিস্থিতিতে জ্বালানির দামের অবস্থা কেমন হবে সে বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়নি।
গোড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ জ্বালানির দাম চলতি বাজার দর অনুযায়ী পরিশোধ করার কথা রয়েছে। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কয়লার দাম কমপক্ষে তিনগুণ বেড়েছে।
মি. হোসেন বলেন, বাংলাদেশের এখন যে পরিস্থিতি তাতে যদি চুক্তির শর্ত পুনর্বিবেচনা করা না হয় এবং এটি বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে বাংলাদেশ একটি ভাল লোকসানের মুখে পড়বে।
সাধারণত নিউক্যাসল ইনডেক্স নামে দামের একটি সূচক অনুযায়ী জ্বালানির দাম নির্ধারণ করা হয়। জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণ সময়ে এটি নিয়ে সমস্যা না হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে যেহেতু এই সূচক দিয়ে কোন জ্বালানির দাম বোঝা যাচ্ছে না তাই বাংলাদেশের জন্য এটা মঙ্গলকর নয়।
ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গোড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে কয়লা ব্যবহার করা হবে তা আসবে আদানির নিজস্ব উৎস থেকে, আদানির জাহাজে করে, আদানির মালিকানাধীন বন্দরে খালাস হবে এবং পরিবহন করা হবে আদানির নির্মিত রেলে করে। আর উৎপাদিত বিদ্যুৎও পরিবহন করা হবে আদানির নির্মিত হাই-ভোল্টেজ লাইনে। চুক্তি অনুযায়ী, শিপিং এবং ট্রান্সমিশনের পুরো খরচ দিতে হবে বাংলাদেশকে।
আর বাংলাদেশ এই বিদ্যুৎ কিনবে দেশের পাইকারী পর্যায়ের বিদ্যুতের দামের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি অর্থ দিয়ে। এমনকি কয়লার দাম যদি আগের অবস্থায় ফিরে যায় তারপরও আদানির বিদ্যুতের দাম প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা স্থানীয় বাজারের তুলনায় ৩৩শতাংশ বেশি পড়বে। কাপ্তাই সোলার ফার্মের তুলনায় আদানির বিদ্যুৎ পাঁচগুণ দামী হবে।
ড. ইজাজ হোসেন বলেন, এই পরিস্থিতিতে যদি আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের উপর একটা দাম চাপিয়ে দেয় তাহলে বাংলাদেশের উচিত হবে এখনই বিদ্যুৎ না নিয়ে জ্বালানির দাম কমার অপেক্ষা করা। তবে এই সময়ে অবশ্যই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে বাংলাদেশকে।
এছাড়া আরেকটি বিকল্প হতে পারে যে, আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে জ্বালানির সরবরাহের দায়িত্ব বাংলাদেশের নিয়ে নেয়া। মি. হোসেন বলেন, এভাবে চাপ দিলে আদানি গ্রুপ চুক্তির শর্তের বিষয়ে সমঝোতা করতে বাধ্য হবে।
আর যদি চুক্তির শর্ত পুনর্বিবেচনা করা হয়, তাহলে এই চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য ভাল বলে মনে করেন তিনি। প্রতিটি চুক্তিতে একটি শর্ত থাকে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হলে চুক্তির শর্ত পুনর্বিবেচনা করা যাবে। ফলে এই চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা যাবে বলেও মনে করেন ড. ইজাজ হোসেন।
দু’হাজার সতের সালে আদানি পাওয়ারের সাথে বাংলাদেশের পিডিবি যে ২৫ বছর মেয়াদী বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করেছিল, তাতে বলা হয়েছিল জ্বালানির আমদানি ও পরিবহন খরচ ক্রেতা দেশই (বাংলাদেশ) বহন করবে।
আর এই দাম ধরা হবে সেসময়ের বাজার দর অনুযায়ী।
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড আদানি পাওয়ারকে যে চিঠি লিখেছে তাতে বলা হয়েছে, আদানি গ্রুপ প্রতি টন কয়লার দাম নির্ধারণ করেছে ৪০০ মার্কিন ডলার। যা আন্তর্জাতিক বাজার দরের তুলনায় বেশ বেশি।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম টন প্রতি ২৫০ মার্কিন ডলারের মতো। আর এর জন্যই কয়লার দাম পুনর্বিবেচনার দাবি উঠেছে।
দু’হাজার বাইশ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড তাদের বার্ষিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলে যে, আদানি পাওয়ার প্ল্যান্টের ক্যাপাসিটি চার্জ বাংলাদেশের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি।
আর কয়লার দাম ধরা হয়েছে দেশের পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়েও প্রায় ৪৫ শতাংশ বেশি। ফলে আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হলে তা ভারত থেকে আনা বিদ্যুতের ব্যয়ের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি খরচ পড়বে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে বাংলাদেশের প্রতি ইউনিট প্রতি খরচ হয় প্রায় সাত টাকার মতো। আর আদানি গ্রুপ থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে খরচ হবে প্রায় ১৮ টাকার মতো।
একই সাথে আদানির বিদ্যুতের জন্য প্রতি বছর প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে।
চুক্তি অনুযায়ী, গোড্ডায় আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা রয়েছে। গত বছরের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু সেটি শেষমেশ হয়নি।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মি. হোসাইন বলেন, আগামী মাসের শেষের দিকে প্রথম ইউনিট বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম ইউনিট বিদ্যুৎ আনার মতো অবকাঠামো বাংলাদেশ অংশে রয়েছে। এটা নিয়ে কোন সমস্যা হবে না।
তবে এরআগে এই ডেডলাইন প্রথমে মার্চের প্রথম সপ্তাহ এবং পরে মার্চের মাঝামাঝি ধরা হয়েছিল। গত ৫ই ফেব্রুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন যে, মার্চের প্রথম সপ্তাহে ৭৫০ মেগাওয়াটি বিদ্যুৎ আসা শুরু হবে।
বিদ্যুৎ আসার এই নির্ধারিত সময় আদানি গ্রুপ বেশ কয়েক বার ‘মিস’ করার কারণে এখন যে মার্চের শেষ নাগাদ বিদ্যুৎ আসবে বলে জানানো হচ্ছে সেটি নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
–
মুন্নী আক্তার, বিবিসি বাংলা