আমদানি করা কয়লায় সাশ্রয়ী দামের বিদ্যুৎ সম্ভব নয়
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারি ও বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেছেন, আমদানি করা কয়লা দিয়ে বাংলাদেশে সাশ্রয়ী দামে ২০-২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কখনোই সম্ভব ছিল না। কোভিড-১৯ জনিত পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে তেল ও গ্যাসের দাম কমে যাওয়ায় তা আরও অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ম. তামিম বলেন, এই অবস্থায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার সরকারি সিদ্ধান্ত সঠিক ও সময়োপযোগী। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারকে বিশেষ কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। কারণ যে প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করতে চায় সেগুলোর একটিও এমন স্তরে নেই যে তা বাতিল করলে সরকারকে কোনো দায় নিতে হবে।
এনার্জি বাংলা’র এক প্রশ্নের জবাবে ম. তামিম বলেন, ২০১০-১১ সালে মূলতঃ কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। তার ওপর তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় কয়লা ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার দেশীয় কয়লা ব্যবহারের পথে অগ্রসর হয়নি। আর প্রয়োজনীয় বন্দরের অভাব ও অগভীর সমুদ্রের কারণে আমদানি করা কয়লা দিয়ে সাশ্রয়ী দামে ২০/২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন তখনও অসম্ভব বিবেচনা করা হয়েছে।
তিনি বল্নে, সর্বোপরি এখন বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে গেছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণের বৈশ্বিক উদ্যোগের কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর ক্রমশই চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে গ্যাসের দাম কমেছে। ধারণা করা হচ্ছে, পরিবেশের দায়সহ আমদানি করা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের তুলনায় আমদানিকৃত এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বেশি হবে না। সুতরাং সেই পথই যুগোপযোগী। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমানোর সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে এনার্জি বাংলাকে ম. তামিম এসব কথা বলেন।
সরকারি সূত্রগুলো জানায়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার বিষয়ে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। এখন তা বাস্তবায়নের পথ খোঁজা হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাত মহাপরিকল্পনা (পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্লান বা পিএসএমপি) পর্যালোচনা করে তা সংশোধনের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে পুরোপুরি সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়নি। আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি কীভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে আনা যায়।’
সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রধান প্রধান কারণ হচ্ছে, কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে তেল-গ্যাসের দাম কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা আর সস্তা জ্বালানি হিসেবে বিকল্প নয়। আমদানি করা কয়লার উচ্চমূল্য, নৌপথ ও বন্দরের সীমাবদ্ধতার কারণে কয়লা আমদানি ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া, নবায়নযোগ্য বিকল্পের ব্যয় ক্রমান্বয়ে কমে আসা এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট সহমতও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোর উদ্যোগের কারণ।
সরকারের এই নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী তা আনুমোদন দিলে মন্ত্রণালয় বা তার অধীনস্ত কোনো সংস্থা কিংবা একটি কমিটি গঠন করে কোন কোন প্রকল্প বাতিল করা যায় এবং তার ফলে সরকারকে কী দায়-দায়িত্ব নিতে হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হবে। তাঁদের সুপারিশ সরকার অনুমোদন করলে পিএসএমপি পর্যালোচনার মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে মোট ২৯টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এরমধ্যে তিনটি প্রকল্প-পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট, রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট এবং মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট পর্যালোচনার আর সুযোগ নেই। কারণ পায়রা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষে চালু হয়েছে। রামপাল বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে। আর মাতারবাড়ি প্রকল্পের কাজও অর্ধেকের বেশি শেষ হয়েছে। মাতারবাড়ি প্রকল্পটি শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নয়। এর সঙ্গে রয়েছে একটি কয়লার টার্মিনাল নির্মাণ এবং সমুদ্র থেকে এই টার্মিনাল পর্যন্ত কয়লাবাহী জাহাজ চলাচলের উপযোগী একটি খাল খনন। এই কাজগুলোর বাস্তবায়ন অনেকটাই এগিয়েছে।
তাই সরকারের পর্যালোচনার বিষয় হবে অবশিষ্ট ২৬টি প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোর মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট। সরকারি সূত্রগুলোর মতে, এগুলোর মধ্যেও এমন কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে যেগুলো পর্যালোচনার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। যেমন ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পায়রা দ্বিতীয় পর্যায়; দেশীয় প্রতিষ্ঠান রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) এবং চীনের নরিনকোর যৌথ উদ্যোগে পায়রার পাশেই বাস্তবায়নাধীন ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি প্রকল্প, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাস্তবায়নাধীন ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রকল্প প্রভৃতি।
এই প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন এবং ইপিসি (ইরেকশন, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) ঠিকাদার নির্ধারিত হয়ে আছে। এ ধরণের প্রকল্প বাতিল করতে গেলে সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এসব প্রকল্পের বিনিয়োগকারী এবং ইপিসি ঠিকাদারেরা চুক্তির ‘ফোর্স মেজার্স’ ও বীমা আইনের আওতায় ক্ষতিপূরণ দাবি করবে। আরও কিছু প্রকল্পে বিনিয়োগ হয়েছে। সেগুলো বাতিল করতে গেলেও সরকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তবে কিছু প্রকল্প আছে যেগুলো বাতিল করার সুযোগ রয়েছে।
প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার যে প্রকল্প সরকার পর্যালোচনা করতে চায় বলে জানা যাচ্ছে তার মধ্যে ১৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রকল্পে বিনিয়োগকারী ও ইপিসি ঠিকাদার হচ্ছে চীনা কোম্পানি। আর ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট প্রকল্পের সঙ্গে আছে জাপানি কয়েকটি কোম্পানি।
চীনা কোম্পানিগুলোর মধ্যে পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অফ চায়না ৬ হাজার মেগাওয়াট; চায়না এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ৪ হাজার মেগাওয়াট; (চীনের) ফার্ষ্ট নর্থ-ইস্ট ইলেকট্রিক পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট; চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট এবং চায়না হুয়ানদিয়ান ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রকল্পের বিনিয়োগকারী ও ইপিসি ঠিকাদার।
এ ছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া মহেশখালী এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগে সমঝোতা স্মারক সই করেছে। এগুলো বাতিল করা অবশ্য অপেক্ষাকৃত সহজ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জ্বালানি খাতের পর্যবেক্ষকদের মতে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপক হারে কমানোর সরকারি উদ্যোগ এসব বিনিয়োগকারীদের জন্য, বিশেষ করে চীন ও জাপানি বিনিয়োগকারীদের বিশেষ দুশ্চিন্তার বিষয় হবে। এ বিষয়টি উপেক্ষা করে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে না। সুতরাং সরকার শেষ পর্যন্ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কতটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
অবশ্য কোভিড-১৯ জনিত বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ একই উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত জুন মাসে পাকিস্তান ৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক কাসিম প্রকল্প বাতিল করেছে। ভিয়েতনাম বেশ কিছু প্রকল্প বাতিল করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে। ভিয়েতনাম এনার্জি ইনস্টিটিউট সে দেশের সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে, আগামী এক দশকের মধ্যে চালু হওয়ার মত ৯ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়েকটি প্রকল্প এবং ২০৩০ সালের মধ্যে চালু হওয়ার প্রক্রিয়াধীন ৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাতিল করার। এই অঞ্চলের প্রধান কয়লা সরবরাহকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া তাঁর কয়লা খনির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে।