চার গ্যাসক্ষেত্র চায় হ্যালিবার্টন: সরকারের না
স্থলভাগের চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্যাসক্ষেত্র তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও রশিদপুর পেতে চায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি হ্যালিবার্টন। তারা দাবি করেছে, তাদের আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করে এসব ক্ষেত্র থেকে বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি হারে গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হবে।
বর্তমানে চারটি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে রশিদপুর সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানি এবং বাকি তিনটি বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানির আওতাধীন। দুটোই রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি। হ্যালিবার্টন গ্যাস উত্তোলনের প্রয়োজনে বাপেক্স, বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডের তথ্য সংরক্ষণ কক্ষে (ডাটা রুম) প্রবেশাধিকার চেয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, হ্যালিবার্টন একক বা যৌথভাবে এই চার গ্যাসক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ পেতে চায়। কিন্তু স্থলভাগের ক্ষেত্রের জন্য প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) বা অংশীদারি চুক্তি বন্ধ রয়েছে অনেক দিন ধরে। স্থলভাগের ব্লকগুলো বিদেশি কোম্পানিকে না দিয়ে বাপেক্সে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। হ্যালিবার্টনকে এসব গ্যাসক্ষেত্র দিতে হলে ‘জরুরি জ্বালানি সরবরাহ আইন’-এর অধীনে পিএসসি ছাড়াই দিতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে।
এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো ছেড়ে দিলে শুধু আর্থিকভাবেই ক্ষতির মুখে পড়বে না দেশ, অতি গোপনীয় তথ্য ব্যবহারের সুযোগ হ্যালিবার্টনকে দিলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করে।
জানা গেছে, হ্যালিবার্টনের এ-সংক্রান্ত চিঠির উত্তর এখনো দেয়নি পেট্রোবাংলা। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি সফরে রয়েছেন। তিনি দেশে ফেরার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে পেট্রোবাংলা। বিদেশে থাকায় এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর বলেন, ‘গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন বৃদ্ধির কাজ নিজেরাই করতে পারি। এর জন্য অন্য কারোর সহায়তার দরকার আছে বলে মনে করি না।’ তিনি বলেন, গ্যাসক্ষেত্রের তথ্য-উপাত্ত অতি গোপনীয় হিসেবে রাষ্ট্র সংরক্ষণ করে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের এখানে তা করা হয় না। পেট্রোবাংলাতে একটি তথ্য সংরক্ষণ কেন্দ্র করেছিলাম। এসব জাতীয় সম্পদ। কোনো অবস্থায়ই তা বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, এখন স্থলভাগ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি গ্যাস তুলছে বিদেশিরা। এর বাইরে আর কোনো আইওসিকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত নয়।
গত ৯ মার্চ হ্যালিবার্টনের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের (এশিয়া-প্যাসিফিক) ভাইস চেয়ারম্যান রাও আবদুল্লাহ পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদের কাছে একটি চিঠি দেন। তাতে বলা হয়, ‘তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে আমরা আগ্রহী। যেসব গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলন কমে যায় সেসব ক্ষেত্রে কাটিং এজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশি হারে গ্যাস উত্তোলনে সাফল্য আমাদের রয়েছে। ইকুয়েডর, মালয়েশিয়া, মেক্সিকোর মতো দেশে ক্ষীয়মাণ গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে।’
বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে গ্যাস উত্তোলনে অধিক পানি একটি বড় সমস্যা উল্লেখ করে এটি দূর করার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তাদের রয়েছে বলেও চিঠিতে দাবি করা হয়েছে। এ চার গ্যাসক্ষেত্রে এখনো প্রচুর গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চায় বলেও চিঠিতে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও রশিদপুর থেকে অধিক হারে গ্যাস উত্তোলনের জন্য এসব ক্ষেত্রের সব তথ্য তাদের সরবরাহ করতে হবে। এ ছাড়া বাপেক্স, বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি ও সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানির তথ্য সংরক্ষণ কক্ষে তাদের প্রবেশের অনুমতি দিতে হবে। চিঠিতে হ্যালিবার্টন জানিয়েছে, এ চার গ্যাসক্ষেত্র ১৯৭০ সাল থেকে তাদের নজরে রয়েছে। এ বিষয়ে জ্বালানি সচিব আবু বক্কর সিদ্দিক বলেছেন, হ্যালিবার্টনকে ওই চার ক্ষেত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। চিঠির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা হয়তো মনে করেছে ক্ষেত্রগুলো নিতে পারলে ভালো ব্যবসা হবে। বাপেক্সের বাইরে কাউকে এ মুহূর্তে কাজ করতে দেওয়ার দরকার রয়েছে বলে মনে করি না।’ স্থলভাগে বাপেক্সের বাইরে অন্য কোনো কোম্পানিকে কাজ না দেওয়ার বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উন্নয়নে বাপেক্স ইতিমধ্যে সামর্থ্য প্রকাশ করেছে। কাজেই যে কাজ নিজেরাই করতে পারি তা কেন অন্যকে দিয়ে করাতে হবে?’
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ৯ আগস্ট স্বাধীনতার ৯ মাসের মাথায় তৎকালীন সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ কম্পানি শেলের কাছ থেকে তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, রশিদপুর ও কৈলাসটিলা ৪৫ লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে কিনে নেন। এরপর এগুলোকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। বর্তমানে দেশের মোট গ্যাসের ৫১ শতাংশের বেশি আসে বিদেশি কম্পানির কাছ থেকে যার প্রতি হাজার ঘনফুটের দাম গড়ে আড়াই ডলার। আর বাকি গ্যাস আসে রাষ্ট্রায়ত্ত কম্পানিগুলোর কাছ থেকে। এ গ্যাসের প্রতি হাজার ঘনফুটের দাম এক ডলারের মতো।
তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের মজুদের পরিমাণ ৭ দশমিক ৫৮ টিসিএফ। এরই মধ্যে এ ক্ষেত্র থেকে ৩ দশমিক ৭৮ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে, যা মোট মজুদের ৫০.১১ শতাংশ। বাখরাবাদের ১ দশমিক ৩৮ টিসিএফ মজুদ থেকে প্রতিদিন উত্তোলন করা হচ্ছে ৩৯ মিলিয়ন ঘনফুট। মোট মজুদ গ্যাসের ৫৪.৪১ শতাংশ এ ক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের মজুদের পরিমাণ ৫ দশমিক ২ টিসিএফ।