উন্নত বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর সাথে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে গুরুত্ব

আসছে বিদ্যুৎ জ্বালানি মিলিয়ে মহাপরিকল্পনা

বিশেষ প্রতিনিধি:
উন্নত বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে করা হচ্ছে বিদ্যুৎ জ্বালানির মহাপরিকল্পনা। ২০৫০ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ জ্বালানির চাহিদা, সরবরাহ, অর্থায়ন, প্রাপ্তি সব বিষয় থাকছে এই পরিকল্পনায়।
মহাপরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার কমানোর কথা বলা হচ্ছে। বিপরীতে বাড়ানো হবে আমদানি করা গ্যাস (এলএনজি) ব্যবহার। সাথে থাকবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি।
বিদ্যুৎ-জ্বালানি প্রাপ্তির সাথে সরবরাহের জন্য থাকবে সঞ্চালন ও বিতরণ পরিকল্পনাও। আর এই সবের জন্য কি পরিমান মূল্য দিতে হবে থাকবে তারও প্রক্ষেপণ।
এবারই প্রথম বিদ্যুৎ আর জ্বালানি একসাথে মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে। প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ যথাযথ না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। তাই এককভাবে বিদ্যুতের পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন দুরুহ।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকা এবারও মহাপরিকল্পনা করতে সহযোগিতা করছে। এ জন্য ইতিমধ্যে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়েছে। এর অধীনে খাতভিত্তিক কয়েকটি কারিগরি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। জাইকাকে এ কাজে সহযোগিতা করছে স্থানীয় দুটি ফার্ম।
২০১০ সালে জাইকার সহযোগিতায় বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা করা হয়। তাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য রাখা হয়। এরমধ্যে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র ছিল ৫০ শতাংশ। ২০১৬ সালে ঐ পরিকল্পনা হালনাগাদ করা হয়। তাতে ২০৪১ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের লক্ষ্য ঠিক করা হয়। আর কয়লার ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশে আনা হয়। নতুন যে পরিকল্পনা হচ্ছে তাতে কয়লার ব্যবহার আরও কমানো হবে বলে জানা গেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সমন্বিত মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে। যেখানে জ্বালানি নিরাপত্তা ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা হবে। এতে ২০৫০ সাল পর্যন্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের পরিকল্পনা এবং দিকনির্দেশনা থাকবে। বিভিন্নক্ষেত্রে আলোচনা কওে চূড়ান্ত করা হবে।
বর্তমান মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনা করে প্রযুক্তি ও নীতিমালা যুগোপযোগী করা, জ্বালানির ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উন্নত করা, বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাথমিক জ্বালানি চূড়ান্ত করা, চাহিদার পূর্বাভাস, এলএনজি আমদানি, পরিবেশ ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করা হয়েছে। একাধিক বিষয় বিবেচনায় চাহিদার পূর্বাভাস ঠিক করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বাংলাদেশের অঙ্গীকারকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাস্তবায়ন অগ্রগতি কম- এমন ১০টি কয়লাভিত্তিক প্রকল্প ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। উদ্যোক্তারা চাইলে কয়লার পরিবর্তে এই প্রকল্পগুলো এলএনজিভিত্তিক করতে পারে। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া ও পটুয়াখালীর পায়রায় কয়লাভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে। এগুলোর উৎপাদনক্ষমতা এক হাজার ৬৮৮ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদনের ৮ শতাংশ। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ৩ শতাংশ বা ৭২২ মেগাওয়াট, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া গ্লাসগোর জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করার প্র্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি
কয়লাভিত্তিক ছয় হাজার ৬৯১ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।
বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির (বিআইএফপিসিএল) এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কেন্দ্র প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এটি পিডিবি ও ভারতের এনটিপিসির যৌথ মালিকানায় নির্মিত হচ্ছে।
সিপিজিসিবিএলের কক্সবাজারের মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ৪৬ শতাংশ কাজ হয়েছে। জাইকার আর্থিক সহযোগিতায় দেশটির সুমিতোমো করপোরেশন এটি বাস্তবায়ন করছে।
রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) ও চীনের নরিনকো ইন্টারন্যাশনালের যৌথ উদ্যোগে নির্মাণাধীন পটুয়াখালীর এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৩৬ শতাংশ। পায়রায় বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানির (বিসিপিসিএল) দ্বিতীয় পর্যায়ের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের অগ্রগতি ২০ শতাংশ। চীনের সিএমসির সঙ্গে যৌথ অংশীদারত্বে কেন্দ্রটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল)।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলমের (এসএস পাওয়ার) এক হাজার ২২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৮২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বরগুনায় নির্মাণাধীন আইসোটেকের বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানির ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৫৮ শতাংশ।
এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
এলএনজিভিত্তিক দুই হাজার ৭৬৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার চারটি কেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। এরমধ্যে একটি দ্বৈত জ্বালানির। খুলনার রূপসায় এনডব্লিউপিজিসিএলের ৮৮০ মেগাওয়াট প্রকল্পের অগ্রগতি ৪০ শতাংশ।
নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিটের ৫৮৩ মেগাওয়াটের একটি দ্বৈত জ্বালানির (এলএনজি/ডিজেল) নির্মাণ অগ্রগতি ৩৩ শতাংশ। একই স্থানে ইউনিক গ্রুপের ৫৮৪ মেগাওয়াটের এলএনজিভিত্তিক প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ২২ শতাংশ। মেঘনাঘাটেই ভারতের রিলায়েন্সের ৭১৮ মেগাওয়াট প্রকল্পের অগ্রগতি ৪৭ শতাংশ। চুক্তি প্রক্রিয়াধীন মেঘনাঘাটে আনলিমা পাওয়ারের ৪৫০ ও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ইউনাইটেড গ্রুপের ৫৯০ মেগাওয়াটের দুটি প্রকল্প।
২০৩০ সালের মধ্যে পায়রায় এনডব্লিউপিজিসিএল ও জার্মানির সিমেন্সের যৌথ অংশীদারত্বের ২৪০০ মেগাওয়াট, মহেশখালীতে পিডিবি ও যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিকের (জিই) যৌথ মালিকানায় ২৪০০ মেগাওয়াট, পিডিবির হরিপুরে ২৫০, সিদ্ধিরগঞ্জে ৬০০, ভেড়ামারায় ৬০০ ও ঘোড়াশালে ২২৫ মেগাওয়াট; গজারিয়ায় আরপিসিএলের ৬০০ মেগাওয়াট, ফেনীর সোনাগাজীতে ইলেকট্রিসিটি পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির (ইজিসিবি) ৬০০ মেগাওয়াট এবং মহেশখালীতে জাপান-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে ৬০০ মেগাওয়াটসহ আট হাজার ২৭৫ মেগাওয়াটের মোট ৯টি এলএনজিভিত্তিক প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
এসব প্রকল্পের অধিকাংশের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ।
বর্তমানে ১৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপিত ক্ষমতা ২৪ হাজার ১৩৮ মেগাওয়াট। এরমধ্যে গ্যাসভিত্তিক ১১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক পাঁচ হাজার ৩৪১, ডিজেল এক হাজার ২৮৬, কয়লা এক হাজার ৬৮৮, পানি ২৩০, আমদানি এক হাজার ১৬০, গ্রিড সৌর বিদ্যুৎ ১২৯ এবং ক্যাপটিভ দুই হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। গ্রিড ছাড়া সৌর ৪০৪ মেগাওয়াট। তবে এখ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন করা গেছে ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট। কারণ বাকীগুলো বেশিরভাগই পুরানো, যার উৎপান ক্ষমতা নেই। আবার জ্বালানির অভাবেও কিছু কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়।