একদিকে গ্যাসের ঘাটতি, অন্যদিকে অপচয়
দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩০০ কোটি ঘনফুটের বেশি। উৎপাদিত হচ্ছে গড়ে ২৫০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি ৫০ কোটি ঘনফুট। এ অবস্থায়ও দৈনিক প্রায় ৪০ কোটি ঘনফুট (মোট উৎপাদনের ১৬ শতাংশ) গ্যাস অপচয় হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক, বাণিজ্যিক—সব ক্ষেত্রেই হচ্ছে অপচয়।
ঘাটতির কারণে দৈনিক সর্বোচ্চ ১৪০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০০ কোটি ঘনফুট। সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে সার কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। কিন্তু অপচয় কমানোর কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয় না।
পেট্রোবাংলার সূত্র এবং বেসরকারি গবেষকেরা বলেন, পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সার কারখানার অদক্ষ যন্ত্রপাতি এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সেকেলে প্রযুক্তির বয়লার এ অপচয়ের প্রধান কারণ। এ ছাড়া আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতেও বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। তাঁরা বলেন, বর্তমানে দেশে প্রতিদিন উৎপাদিত প্রায় ২৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ, সার ও শিল্পপণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, যন্ত্রপাতির দক্ষতা বাড়ানো হলে তাতে সর্বোচ্চ ২১০ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস লাগার কথা নয়। অর্থাৎ বর্তমানে চাহিদার তুলনায় দেশে দৈনিক গ্যাসের যে ঘাটতি রয়েছে, অপচয় বন্ধ করে তার প্রায় সবটাই পূরণ করা সম্ভব।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি দক্ষতা (এনার্জি এফিশিয়েন্সি) বিষয়ের গবেষক ইজাজ হোসেন বলেন, জ্বালানি অপচয়ের বিষয়টি দীর্ঘদিন একেবারেই অবহেলিত ছিল। যুগের পর যুগ অদক্ষ যন্ত্রপাতি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয় করা হয়েছে। এখন জ্বালানি-সংকট দেখা দেওয়ায় বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কিছু কাজও শুরু হয়েছে। বেসরকারি খাতের অল্প কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জ্বালানির দক্ষ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেছে। সরকারও তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
তিতাসের জরিপ: দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি একটি জরিপ করে দেখেছে, তাদের বিতরণ এলাকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর পুরোনো প্রযুক্তির বয়লার নতুন প্রযুক্তিতে রূপান্তর করে দৈনিক ১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব। এই রূপান্তরে ব্যয়ও বেশি নয়। এ ছাড়া আবাসিক গ্রাহকদের চুলা উন্নত প্রযুক্তির করা হলে এবং রাস্তা থেকে রান্নাঘরে গ্যাস সরবরাহের লাইন যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে প্রতিদিন গ্যাস সাশ্রয় হবে ১০ কোটি ঘনফুট। এ কাজেও ব্যয় হবে সামান্য।
পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতিদিন দেশে উৎপাদিত মোট গ্যাসের ১২ শতাংশ (৩০ কোটি ঘনফুট) ব্যবহৃত হচ্ছে আবাসিক খাতে। আর শুধু তিতাসের এলাকায় প্রতিদিন ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের অপচয় হচ্ছে।
তিতাস অবশ্য শিল্পে উন্নত প্রযুক্তির বয়লার ও উন্নত চুলার ব্যবহার উৎসাহিত করে গ্যাস সাশ্রয়ের উদ্যোগ কয়েক বছর আগেই নিয়েছে। কিন্তু এখনো এতে উল্লেখযোগ্য ফল মেলেনি। সম্প্রতি হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পগ্রাহক তাঁদের বয়লার ও যন্ত্রপাতি জ্বালানি-সাশ্রয়ী করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে তিতাস সূত্র জানায়।
বিদ্যুতে অপচয়: বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, দেশে এখন গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদনক্ষমতা ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এসব কেন্দ্রের জ্বালানি দক্ষতা (ফুয়েল এফিশিয়েন্সি) ৩৫ শতাংশের মধ্যে। কিন্তু এখন উন্নত প্রযুক্তির গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি দক্ষতা ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ। পুরোনো কেন্দ্রগুলোর প্রযুক্তি পরিবর্তন করা হলে এখনকার তুলনায় প্রায় অর্ধেক জ্বালানি ব্যবহার করে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
এ ব্যাপারে সরকারি সূত্রগুলো জানায়, চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন দীর্ঘদিন ধরে অনেক কম থাকায় এবং অর্থসংকটের কারণে পুরোনো কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে প্রযুক্তি পরিবর্তনের সুযোগ কখনো পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, আশির দশকে চীনের ঋণে চট্টগ্রামের রাউজানে বিদ্যুৎকেন্দ্র করার সময়ও কেন নতুন প্রযুক্তি নেওয়া হলো না। তখন তো আর পুরোনো কেন্দ্র বন্ধ রেখে করার প্রশ্ন ছিল না। আসলে সরকার জ্বালানি দক্ষতার বিষয়টিকে কখনো তেমন গুরুত্ব দেয়নি।
পিডিবি সূত্র জানায়, তাদের প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যেগুলোর জ্বালানি দক্ষতা সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ। এই কেন্দ্রগুলোতে যে পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই পরিমাণ জ্বালানি দিয়ে এখনকার তুলনায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে পারে। সে জন্য ওই কেন্দ্রগুলো নবায়নের জন্য বিপুল অর্থ দরকার। তবে সেই অর্থের পরিমাণ অপচয় হওয়া জ্বালানির তুলনায় অনেক কম।
বিদ্যুতের আরেকটি বড় অপচয়ের ক্ষেত্র ক্যাপটিভ পাওয়ার (বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন)। এ ক্ষেত্রে কম দামে গ্যাস দেওয়া হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের দক্ষতা ক্ষেত্রবিশেষে ২০ শতাংশের কম।
সারেও অপচয়: ইউরিয়া সার কারখানাগুলোতেও জ্বালানির অপচয় ব্যাপক। কর্ণফুলী সার কারখানা (কাফকো) বিদেশি বিনিয়োগে স্থাপিত একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। এ কারখানায় এক মেট্রিক টন ইউরিয়া উৎপাদনে গ্যাস লাগে ২৪ হাজার ঘনফুট। অপর দিকে সরকারি কারখানাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ যমুনা সার কারখানায় এক টন ইউরিয়া উৎপাদনে গ্যাস লাগে ৩২ হাজার ঘনফুট। চিটাগাং ইউরিয়া সার কারখানায় লাগে ৪২ হাজার; ঘোড়াশালের জিয়া ও পলাশ সার কারখানায় লাগে যথাক্রমে ৪৩ ও ৪৯ হাজার ঘনফুট। আশুগঞ্জের সার কারখানায় লাগে ৭৩ হাজার ঘনফুট। ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় লাগত ৮২ হাজার ঘনফুট। এটি বন্ধ করে নতুন শাহজালাল সার কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে।
অধ্যাপক ইজাজ বলেন, কারখানাগুলোর প্রযুক্তি পরিবর্তন করে এ অপচয় বন্ধ করা যায়। কাফকোর মতো প্রতিষ্ঠানকে তা করতেই হয়। কারণ, তাদের তো আন্তর্জাতিক দামে গ্যাস কিনতে হয়। দেশের কারখানাগুলো কম দামে গ্যাস পায়। ফলে জ্বালানির অপচয় নিয়ে তাদের এবং সরকারের মাথাব্যথা কম।
সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলোর হিসাব অনুযায়ী, এই ক্ষতি সরকারি খাতই বেশি করছে। সরকার কারখানাগুলোর আধুনিকায়নে বিনিয়োগ না করায় এ ক্ষতি হচ্ছে। আবার এ ক্ষতির কারণেই সরকার বা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে নতুন বিনিয়োগ করার মতো অর্থ আসছে না।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শিল্পের বয়লার ও পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করে জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানোর একটি কার্যক্রম নেওয়া হয়েছিল। কিছু কাজও হয়েছিল। তবে সময়স্বল্পতায় তা বেশি দূর এগোয়নি।
– সৌজন্যে প্রথম আলো