এভাবে বিদ্যুৎ বিল আদায় অবৈধ

বিদ্যুৎ বিল মিটার রিডিং-এর ভিত্তিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারিত ধাপভিত্তিক মূল্যহারে তৈরি হয়। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে সে বিল আদায় করে বিতরণ কোম্পানি। বিলম্বে জরিমানাও আদায় করে। জরিমানাসহ নিদির্ষ্ট সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধ না হলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। মাঁসুলের বিনিময়ে আবার সংযোগও দেয়। বিল তৈরি, আদায়, বিলম্বে জরিমান আদায়, আবার সংযোগে মাসুল আদায়- এমন সব কিছু বিইআরসি’র আইন বা আদেশে করে।

করোনা সংক্রমণের কারণে সরকার তিন মাসের বিদ্যুৎ বিল আদায়ে বিলম্ব মাশুল মওকুফ করে। কিন্তু পরে বিতরণ কোম্পানি বা সংস্থাগুলো মিটার রিডিং না নিয়েই ওই তিন মাসের বিদ্যুৎ বিল করে। ইচ্ছামাফিক ধরে বকেয়া বিল বানায় এবং সে বিল আদায়ের জন্য মাঠে নামে। পরিশোধ না হলে জরিমানা আদায়েরও ঘোষণা দেয়।
এই বিদ্যুৎ বিল আদায়ের কৌশল কি হবে, তিন মাসে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ একত্রে ধরে বকেয়া আদায় করা যাবে কিনা, তাতে ধাপভিত্তিক মূল্যহার সুবিধা দেয়া হবে কিনা, করোনাকালে বকেয়া/নিয়মিত বিল অনাদায়ে জরিমানা আদায় করা যাবে কিনা, বিল আদায় না হলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে কিনা এবং আবার সংযোগে বাড়তি মাশুল লাগবে কিনা – এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার কোন বিতরণ সংস্থা বা কোম্পানির নেই। এমন কী বিদ্যুৎ বিভাগেরও নেই। কেবল একক এখতিয়ার বিইআরসি’র।
বিদ্যুতের মূল্যহার পরিবর্তনের জন্য যেমন বিইআরসি’র নিকট আবেদন করতে হয়, তেমন ওইসব ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের জন্য বিইআরসি’র নিকট আবেদন করতে হয়। ওই আবেদনের ওপর বিইআরসি গণশুনানি করবে। সে গণশুনানির ভিত্তিতে সরকার স্থগিত সময়ের বিদ্যুৎ বিল আদায় কৌশল সম্পর্কিত আদেশ দেবে। সে আদেশের বাইরে বিদ্যুৎ বিল আদায়ে অন্য কোন কিছু করার সুযোগ বিতরণ কোম্পানি কিংবা বিদ্যুৎ বিভাগের নেই। তাই ওইসব অন্যায় ও অযৌক্তিক বিদ্যুৎ বিল অবৈধ ও বেআইনী। বিইআরসি আইন স্পষ্ট লংঘন।
করোনার কারণে মিটার রিডিং নেয়া সম্ভব না হওয়ার অজুহাতে ওই তিন মাসের বকেয়া বিল একত্রে মনগড়া হিসাবের ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে। ওইসব বিলের পরিমান নির্ধারণের যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য কোন ভিত্তি নেই। অভিযোগের স্বপক্ষে পাওয়া প্রমাণে দেখা যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে বকেয়া বিল সম্ভাব্য যৌক্তিক বিল অপেক্ষা ১০ গুণ। এমন ঘটনা সরকারের ভোক্তাবন্ধব ঘোষণাকে ভোক্তাবিরোধীতে পরিণত করেছে। এই বেআইনী কাজে ভোক্তা একদিকে যেমন নিপীড়িত, অন্যদিকে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন। ফলে এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ জরুরি।
কর্তৃপক্ষকে এখনই যা যা করতে হবে তাহলো, সকল বিল বাতিল করতে হবে। প্রত্যেক ভোক্তাকে মাসভিক্তিক আলাদা আলাদা নতুন বকেয়া বিল দিতে হবে। কিস্তিতে সে বিল পরিশোধেরও সুযোগ দিতে হবে। বিল নির্ধারণের মানদণ্ড হবে Ñ আগের দুই/তিন মাসের বিলের গড় পরিমান অথবা আগের বছরে একই মাসের বিলের পরিমান। প্রকৃত পরিমান অপেক্ষা এ-বিল কম বা বেশী হলে তা সমন্বয় করার সযোগ রাখতে হবে। অন্যায় ও অযৌক্তিক বিল প্রদানের দায়ে বিতরণ কোম্পানির বিরুদ্ধে রেগুলেটরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিইআরসি আইনে ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করা অন্যতম। বিইআরসি আইনের ২২(ক) উপধারায় আছে ‘ভোক্তা বিরোধের প্রতিকার এবং অসাধু বা মনোপলি ব্যবসায় ভোক্তার প্রতিকার নিশ্চিত করা।’
শিল্প বা বাণিজ্যিক ভোক্তার মধ্যে বিরোধ বিইআরসি নিস্পত্তি করে। কিন্ত সাধারণ ভোক্তার মধ্যে বিরোধ নিস্পত্তি করেনা।
বিইআরসি কোন তথ্য রাখেনা। যেসব মাসের বিল প্রদান বন্ধ ছিল, গত বছরের সেসব মাসে প্রতিটি ভোক্তার ব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমান কম্পিউটারেই আছে। সে তথ্য অনায়াসে বিইআরসি সংগ্রহ করতে পারে এবং অভিযোগের যথার্থতা খতিয়ে দেখতে পারে। কিন্তু দেখবে না। অথচ বিইআরসি’রও বেতন-ভাতা ভোক্তার অর্থে হয়। বিতরণ কোম্পানিগুলো ভোক্তার অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ভোক্তাকেই তার দারস্থ হতে বলেছে। কিন্তু তা আইনানুগ নয়। অভিযুক্তকে শাস্তি দেবে বলেছে। নিজেকে অভিযুক্ত মনে করেনি, করলে বিইআরসিতে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব নিয়ে আসতো। করোনায় ভোক্তাকে তার দারস্থ হতে বলতে বিবেকে বাঁধতো।
বিরোধ নিষ্পত্তি করতে বিদ্যুৎ বিভাগ দুইজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্ত্বে টাস্কফোর্স গঠন করেছে। তবে ভোক্তাদের তাদের কাছে যেতে হবে। তাঁরাও আইনী পথে বিরোধ নিষ্পত্তি করবেন না। তাহলে তাঁরা এমন কি জাদু বলে সব ঠিক করবেন! বিতরণ কোম্পানীগুলোর বোর্ড চেয়ারম্যান ও মেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ও অতিরিক্ত সচিব তথা উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা। তাঁরা কোম্পানীর সর্বময় ক্ষমতার মালিক হওয়া স্বত্ত্বেও তাঁদের দ্বারা সে বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভব হয়নি। এখন অতিরিক্ত সচিবের ক্ষমতা বলে তাঁরা তা করবেন। তাঁদেরই বক্তব্য কোম্পানী আইনে কোম্পানীর বোর্ডই সব। সরকারের কোন কর্তৃত্ত্ব নেই। তাই তাঁরা চেয়ারম্যান মেম্বব হিসেবে কোম্পানীর সব হলেও বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কেউ নন। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের এ কেমন অভিনব তামাসা! বিদ্যুৎ ও জ্বালানীখাতে এমন সব তামাসার কোন শেষ নেই।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়নে এখাত দুর্নীতি মুক্ত হতে হবে। সে জন্য সুশাসন দরকার। তাই আইনী শাসন প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কেবল তিন মাসের অবৈধ বকেয়া বিদ্যুৎ বাতিল নয়, বিতরণ ব্যবস্থাপনার সকল পর্যায়ের দায়িত্ব থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী বিভাগের সকল কর্মকর্তার অবমুক্তি দরকার। কারণ ভোক্তারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতকে স্বার্থসংঘাত মুক্ত দেখতে চায়।

 

ডিন ও বিভাগীয় প্রধান
ইলেক্ট্রোনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি