এলএনজি’র প্রাথমিক পাঠ: ভারতের শিক্ষা

ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে জ্বালানি সংকট নিরসন অত্যন্ত জরুরি। প্রাকৃতিক গ্যাসের মত সস্তা, আর তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অপ্রতুল মজুদ আর যোগানের কারণে বাংলাদেশ উচ্চ মুল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি শুরু করেছে। এলএনজি আমদানিতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতাও খুব বেশি দিনের পুরনো নয়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারতের এই এলএনজি বিষয়ক অভিজ্ঞতা সহায়ক হতে পারে বাংলাদেশের মত নব্য এলএনজি ভোক্তার।

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর পরিবেশের কথা ভেবে উন্নত দেশসহ সারা বিশ্বই এখন সংকট নিরসনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপর জোর দিয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত প্রাথমিক বিনিয়োগ আর কমিশনিং করতে তুলনামূলক অধিক সময় লাগার কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকক্ষেত্রে সময়মত উপযুক্ত সমাধান দিতে পারে না। এদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি হওয়া সত্ত্বেও প্রাকৃতিক গ্যাস বরাবরই সস্তা আর তুলনামূলক কম দূষণকারী জ্বালানি হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।

ভারতে নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাসের যে মজুদ বা যোগান আছে তা শিল্পের চাহিদার তুলনায় নগণ্য। আবার নিজস্ব তেল, গ্যাস অনুসন্ধানে প্রয়োজন প্রচুর বিনিয়োগ, এরপর আবার আছে মজুদ প্রাপ্যতার অনিশ্চয়তা। ফলে, গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে চাহিদার যোগান দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। সাম্প্রতিক সময়ে এলএনজি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, মুল্য নির্ধারণ পদ্ধতির প্রবর্তন, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, আর ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যকার চুক্তির ধরণগত দিকের উন্নয়ন আসলে এই এলএনজি বাণিজ্যকে আগের চেয়ে অনেক বেশি গতি দান করেছে। অন্য সব উন্নয়নশীল দেশের মত ভারতের বাজারে এলএনজি প্রবেশ করাতে অনেক ধরণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

এই ধরণের বিষয় আরও অনেক আছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের মানসিক ও সংস্কৃতিক, কাজের ধরণ, ভৌগলিক অবস্থা একই রকম। এজন্য ভারতের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের উপযোগি হতে পারে। বাংলাদেশের এই শিল্প উন্নয়নে ভারতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে।

ষাটের দশকে আসাম আর গুজরাটে যখন গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেল তখন পাইপলাইন নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে শিল্পে সে গ্যাস পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়নি। অধিকাংশ গ্যাস তখন জ¦ালিয়ে ফেলা হত নয়ত কাছাকাছি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নামমাত্র মুল্যে দিয়ে দেয়া হত। ফলে, ভারত সরকার এই গ্যাস সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ আর পরিবহনের জন্য গঠন করে গ্যাস অথরিটি অব ইন্ডিয়া। প্রথমদিকে বিদ্যুৎ, সার সহ অন্যান্যক্ষেত্রে গ্যাসের ব্যবহারে খুব বেশি আগ্রহ সবাই দেখায়নি ফলে এই কর্তৃপক্ষের বিকাশ ছিল মন্থর। আর গ্যাসের দাম ছিল কম। সময়ের পরিক্রমায় গ্যাসের চাহিদা বাড়তে থাকে এবং সরকারকে সীমিত বরাদ্দ হিসেবে গ্যাস বিতরণ করতে হয়। সরকার গ্যাসে রেশন দিতে থাকে আর চাহিদা বাড়তে থাকে। ২০০৫ সালে জাতীয় জ্বালানি মিশ্রনে গ্যাসের অংশ ছিল ৬ শতাংশ, এলএনজির ব্যবহার বাড়ায় এখন ১১ শতাংশ।

ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এদিকে পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রক কাতারের রাসগ্যাস থেকে বাৎসরিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি আমদানির চুক্তি করে আর এর ফলে এক জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এই এলএনজি আমদানির চুক্তিটি ছিল ‘টেক অর পে’ শর্তাধীন। আবার এলএনজি ব্যবহার করতে চাইলে ভোক্তাদের এক জটিল চুক্তি ব্যবস্থার মধ্য দিয়েও যেতে হত যেখানে এর আগে মাত্র ২, ৩ পাতার চুক্তির ভিত্তিতে ভোক্তাদের কম মুল্যে দেশীয় গ্যাস দিয়ে আসছিল। এগুলো ছাড়াও আরও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল এরকম-

  • এলএনজির দাম ছিল দেশীয় গ্যাসের থেকে প্রায় ৩ গুণ বেশি
  • ন্যুনতম ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত ‘টেক অর পে’ দায়
  • দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি-সাধারণত ২০-২৫ বছর পর্যন্ত
  • এলএনজির দাম ক্রুড অয়েলের দামের উপর নির্ভরশীল
  • গ্যাসভিত্তিক শিল্পায়নের গতির শ্লথতা এবং পুরানো শিল্পকে গ্যাস ব্যবহারের উপযোগি করার জন্য বিনিয়োগ
  • এলএনজি সরবরাহ চুক্তির জটিল শর্তাবলী
  • আন্তর্জাতিক গ্যাস সরবরাহ অবিরত থাকার অনিশ্চয়তার উপলদ্ধি
  • আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়হীনতা। যেমন- সার মন্ত্রক সব সার কোম্পানিগুলোকে এলএনজি ভিত্তিক কোন চুক্তি করতে নিষেধ করে দেয়। বিদ্যুৎ মন্ত্রকও সব জাতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদক কোম্পানিকে নিষেধ করে দেয় এলএনজি ব্যবহার করতে

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে শেষমেশ কাতার আর ভারতের দুই দেশের সরকার পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে, রাসগ্যাস মুল্য নির্ধারণ পদ্ধতিটা পুনর্মূল্যায়ন করতে রাজি হয় আর প্রথম ৫ বছরের জন্য নির্দিষ্ট মুল্যে গ্যাস দিতে রাজি হয়। এরপর সার মন্ত্রক আর বিদ্যুৎ মন্ত্রকের সঙ্গেও প্রচুর বৈঠক আর উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে এলএনজির অনিবার্যতা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এতকিছুর পরেও ‘গেইল’ (জিএআইএল) ২০০৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে এসেও এক ফোটা এলএনজি নেওয়ার মতও কোন ক্রেতা খুজে পায় নি, যেখানে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এলএনজির প্রথম চালান দেশে পৌঁছানোর কথা।

এহেন অচলাবস্থা নিরসনে গ্যাস কর্তৃপক্ষের নবনিযুক্ত সিইও এই কোম্পানির মার্কেটিং টিমকে পরিবর্তন করে নতুন করে গঠন করেন। তারা সার ও বিদ্যুৎ কোম্পানির পেছনে অযথাই সময়ক্ষেপণ না করে তুলনামূলক অন্যান্য ছোট শিল্পের দিকে মনোনিবেশ করেন। তাদের জন্য এলএনজির জটিল ও বিশাল চুক্তিপত্রটিকে তারা মাত্র ৩, ৪ পাতায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হন। এতে কিছু ছোট শিল্পকে এলএনজি ব্যবহারে রাজি করাতে সক্ষম হয়।

দাহেজ এলএনজি টার্মিনাল দিয়ে ২০০৪ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হলে ভারতের গ্যাসের ব্যবহার এক লাফে অনেক বেড়ে যায়। এতে করে চীনের পর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে গ্যাস ব্যবহারে ভারত ২য় সর্বোচ্চ (৬ দশমিক ৬ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছিল। ২০০৫ সালে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে গ্যাসের ব্যবহার ছিল ৪৩ শতাংশ আর সার শিল্পে ছিল ২৮ শতাংশ। ২০১০ সালে এসে দেখা যায় ভারতের জাতীয় জ্বালানি মিশ্রনে গ্যাসের অবদান ১১ শতাংশ।

ভারতে বর্তমানে ৮টি এলএনজি টার্মিনাল আছে, এর মধ্যে ৬টি চলমান আর ২টি এখনও নির্মাণাধীন। এগুলোর সম্মিলিত রি-গ্যাসিফিকেশন ক্ষমতা বাৎসরিক ৪২ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ টার্মিনালই এখন খুব কম ব্যবহৃত হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে এলএনজির দীর্ঘমেয়াদী দাম নির্ধারণ সার ও বিদ্যুৎ খাতের জন্য উপযুক্ত নয়।

পরিবর্তিত বিশ্বে বর্তমানে গ্যাস উৎপাদন যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে এলএনজি যোগানদাতা ও পরিবহনকারীর সংখ্যা আবার এদিকে তেলের দামও ক্রমনিম্নমুখী। এমতবস্থায় এলএনজির স্পট মার্কেট ভ্যালু কখনো কখনো দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের থেকেও কমে যেতে দেখছি আমরা। আমদানিকারকরাও তাই এখন দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির বদলে ১ থেকে ৪/৫ বছরের স্বল্পমেয়াদী এলএনজি আমদানি চুক্তি আর স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার দিকে ঝুঁকছে। যদিও স্বল্পমেয়াদী চুক্তিতে এলএনজির মুল্য এখনও ক্রুড অয়েলের উপরে নির্ভরশীল। সে হিসেবে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনাই স্বল্প খরচে গ্যাস প্রাপ্তির সাময়িক নিশ্চয়তা দিচ্ছে। ভারত গড়ে ৫২ কার্গো এলএনজি আমদানি করে স্পট মার্কেট থেকে। সরকার গ্যাস ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপগুলো সহ আরও বেশকিছু কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে-

  • পেট্রোলিয়াম ও ন্যাচারাল গ্যাস রেগুলেটরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের এ খাতে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া আর ছোট শিল্পে গ্যাসের স্বচ্ছন্দ পরিবহন আর ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে।
  • যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের দ্বারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘সিটি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন’ প্রকল্প পরিচালনা করা
  • যানবাহনের জন্য এলএনজি রিফুয়েলিং ষ্টেশন স্থাপন করা
  • বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে গ্যাস পরিবহন সেবা উন্মুক্তকরণের উদ্দেশ্যে নীতিমালা প্রণয়ন
  • নিজস্ব গ্যাস এবং রি-গ্যাসিফাইড এলএনজি গ্যাসের দামের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান থাকায় ২০১৩-১৪ সালে দেশীয় গ্যাসের দামের নতুন মুল্য নির্ধারণ পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়

ভারতে এলএনজিকে পরিবহন, স্থানীয় শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে বা গৃহস্থলী ভোক্তাদের নিকট তরল জ্বালানি হিসেবে পরিচিত করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। আজ পর্যন্ত ২৭টি রাজ্যের ২২৮ ভৌগলিক এলাকার ৪০৪ জেলায় সিটি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন এজেন্সিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এতে প্রায় ৭১ শতাংশ ভারতীয় জনগণ ও ভারতের সমগ্র আয়তনের ৫৩ শতাংশ সিটি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন প্রকল্পের আওতায় এসেছে। গেইল যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এটি গ্যাসের একক বৃহত্তম যোগানদাতা এবং একইসঙ্গে সরবরাহকারী, বিপণনকারী তাই গ্যাস মার্কেটে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে গেইলকে ভেঙে দুটি আলাদা সত্ত্বা তৈরি করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এবং সরকার ইতিমধ্যে এর বিপণন এবং পরিবহন বিভাগকে ভেঙে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুইটি আলাদা কোম্পানি গঠন করার প্রক্রিয়াতে কর্মরত।

বাংলাদেশ নতুন এলএনজির ভোক্তা হিসেবে ভারতের এইসব শিক্ষা থেকে হয়ত কিছু অগ্রিম ব্যবস্থা নিতে পারে।

লেখক: সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেন্ট্রাল ইউপি গ্যাস লিমিটেড, ভারত এবং সাবেক নির্বাহি পরিচালক জিএআইএল (ভারত) লিমিটেড

অনুবাদ: মাহফুজ রিশাদ