এলপিজি’র দাম নির্ধারণ বিতর্ক

রফিকুল বাসার:
ঝুঁকি না থাকলে তাকে ব্যবসায় বলা হয় না। ব্যবসায় হতে গেলে তার প্রথম ও প্রধান উপাদান হতে হবে ঝুঁকি। কিন্তু বোতল গ্যাসের ক্ষেত্রে বিইআরসি বা সরকার সেই ঝুঁকি মুক্ত করে দিচ্ছে। মুনাফা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এটাকে কমিশন ভোগি ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। শুধু তাই নয় ভোক্তাও নির্ধারিত। তাদের হাত-পা বাঁধা। নিতে বাধ্য। সরকার বাধ্য করছে এই পণ্য নিতে। গ্যাস সংযোগ না দিয়ে এই বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
ঝুঁকি নেই। প্রতিযোগিতা নেই। প্রতিযোগিতা নেই এই অর্থে যে নিশ্চিত বাজার। আর সে জন্যই প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। নিশ্চিত বাজার হওয়াতে কোন সামাজিক সচেতনতার উদ্যোগ নেই। শুধু দাম নিয়েই মাথা ব্যথা। সচেতনতা নিয়ে নয়। ন্যায্য দাম নিয়েও নয়। নিরাপত্তা নিয়ে কোন আলোচনা নেই।
এভাবে চলছে তরল প্রেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বা বোতল গ্যাসের দাম নির্ধারণ নিয়ে বিতর্ক।
বিকর্তের মূল জায়গা চারটে। বিইআরসি আর উদ্যোক্তাদের দরকষাকষির জায়গা তৈরি হয়েছে বিনিয়োগের লাভ, প্রশাসনিক খরচ, সিলিন্ডারের অবচয় এবং ৯ শতাংশ লাভ নিয়ে। বিইআরসি যে দাম নির্ধারণ করেছে সেখানে এধরণের কোন বিষয়ে অর্থ বরাদ্দ রাখেনি। কিন্তু এগুলো চাইছে উদ্যোক্তারা। ১২ কেজি বোতলের প্রতি বোতলের জন্য উদ্যোক্তারা চাইছেন বিনিয়োগের লাভ ১৫০ টাকা, প্রশাসনিক খরচ ৮০ টাকা, অবচয় ৫৯ টাকা এবং ৯ শতাংশ লাভ ১০০ টাকা। কিন্তু বিইআরসি এগুলোর কোনটাই দেয়নি।
বিইআরসিতে উদ্যোক্তাদের নতুন করে দেয়া প্রস্তাব আর জুন মাসের জন্য নির্ধারণ করা দাম পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
বিইআরসি উদ্যোক্তাদের চাওয়ার চেয়ে দুটো বিষয়ে বেশি বরাদ্দ দিয়েছে। আমদানিতে পরিবহন খরচ বা প্রিমিয়াম আর বোতলজাত করার খরচ। চাহিদার চেয়ে প্রিমিয়ামে ৪ টাকা এবং বোতলজাতকরণে ৬১ টাকা বেশি দিয়েছে।
উভয়ের মধ্যে মত পার্থক্য নেই সরবরাহকারীর খরচ ও লাভ এবং খুচরা বিক্রেতার খরচ ও লাভ নিয়ে। এদুইখাতে যথাক্রমে ২৪ টাকা ও ২৭ টাকা দিচ্ছে বিইআরসি। উদ্যোক্তারাও তাতেই খুশি।
আমদানি থেকে ভোক্তার কাছে সরবরাহ করতে অন্ততঃ ১৫ বিষয়ের উপর নির্ভর করে দাম ঠিক করা হচ্ছে।
দাম নির্ধারনি সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটনি কমিশন (বিইআরসি) বলছে, বেসরকারি উদ্যোক্তদের দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে এবং গণশুনানির মাধ্যমে দাম নির্ধারণ হয়েছে। আর উদ্যোক্তরা বলছেন, যে দাম দেয়া হয়েছে তা অযৌক্তিক।
যৌক্তিক আর অযৌক্তিক এর সমাধান করতে ৮ই জুলাই গণশুনাসির আয়োজন করেছে বিইআরসি।
এই দুইয়ের আলোচনা চলছে। কিন্তু মাঝে বেশি দামেই কিনছেন গ্রাহক। তার কোন সমাধান নেই। তিন মাস হলো দেশে এলপিগ্যাস বা বোতল গ্যাসের দাম নির্ধারণ কওে দিয়েছে। কিন্তু তা একদিনের জন্যও বাস্তবায়ন হয়নি।
বিইআরসি নির্ধারণ করা দামের সাথে উদ্যোক্তাদের বা নোয়াবের দাবির মধ্যে ১২ কেজি বোতলের সিলিন্ডারে পার্থক্য ৩৬৯ টাকা।
বিইআরসি ১২ কেজির দাম নির্ধারণ করেছে ৯৭৫ টাকা। উদ্যোক্তরা বলছেন এটা হওয়া উচিত ১ হাজার ৩৪৪ টাকা ৪৩ পয়সা।
বিইআরসি বলছে, উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে খরচের হিসাব নেয়া হয়েছে। এরপর সেই হিসাব পর্যালোচনা করেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ এখন বলছে সেই হিসাবে গড়মিল আছে।
উদ্যোক্তরা বলছেন, বিইআরসির দাম নির্ধারণে পরিচালনা খরচ, বিনিয়োগের লাভ, পরিবেশক ও খুরচা বিক্রেতাদের লাভ, ঋণের সুদ, সিলিন্ডারের অবচয়, মজুদ ও রক্ষাবেক্ষণসহ ৭টি বিষয়ে খরচের হিসাব বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এক তরফা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দাম নির্ধারনে সাতটি উপখাতে ১৪৮ টাকা কম ধরা হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় না নিলে এলপিজি খাতের চলমান সংকট বাড়বে। ঝুঁকিতে পড়বে এই খাতের ৩২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ – এমনই বলছেন বিনিয়োগকারীরা।
এবিষয়ে সংশ্লিষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন দাম বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। শুধু নিয়ম বেঁধে দিতে হবে। সেই অনুযায়ি দাম নির্ধারণ হবে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যে দাম হবে সেই দামেই বিক্রি হবে।
অবশ্য বিইআরসিও সে পথেই হাঁটছে। তারা বলছে, সত্যিকার অর্থে প্রতিমাসে দাম নির্ধারণ হবে না। প্রতিমাসে নিয়ম অনুযায়ি শুধু সৌদি আরামকোর দামের সাথে সমন্বয় করে নতুন দাম ঠিক করা হবে। অর্থাৎ শুধু আমদানি খরচ পরিবর্তন হলেই দাম পরিবর্তন হবে। না হলে একই থাকবে। স্থানীয় বাজারে নিশ্চয় প্রতিমাসে উদ্যোক্তাদের খরচও পরিবর্তন হবে না। আর সেই খরচ পরিবর্তন না হলে প্রতিমাসে দাম নির্ধারণের প্রয়োজনও হবে না। আমদানি খরচ পর্যালোচনা করে শুধু সমন্বয় করা হবে। তারপরও কোন সমস্যা হলে সেটাও পর্যালোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।
বিইআরসি সদস্য মকবুল ই এলাহী চৌধুরী বলছেন, ভোক্তা এবং উদ্যোক্তা উভয়ের স্বার্থ বিবেচনা করা হয়েছে। সৌদি আরামকোর চুক্তিমূল্য দেখেই দাম ঠিক করা হয়েছে। এখানে পরিবহন খরচ, সরবরাহকারী, ডিলার, সব বিবেচনা করা হয়েছে। আমদানি থেকে ভোক্তার কাছে পৌছানো পর্যন্ত যত খরচ আছে সব বিবেচনা করেই দাম ঠিক করা হয়েছে। তারপরও যদি কোন সমস্যা থাকে তবে তা আলোচনার মাধ্যমে সমন্বয় সম্ভব।
বসুন্ধরা এলপি গ্যাস কোম্পানির হেড অব ডিভিশন প্রকৌশলী জাকারিয়া জালাল বলছেন, গ্যাসের বিক্রি দাম নির্ধারণ করা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বিইআরসির নির্ধারণ করা দামে বিনিয়োগের লাভ, ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটর কমিশন, পরিবহন খরচ যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। এগুলো যথাযথ না হলে ব্যবসায়ের বিনিয়োগ হুমকিতে পড়বে।
সকল আলোচনা শেষে উদ্যোক্তাদের চাহিদাপূরণের সাথে ভোক্তার ন্যায্য দাম নিশ্চিত হবে এমন আশা সকলের।
চূড়ান্ত হওয়ার পথে এলপিজি নীতি
এলপি গ্যাস ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স ফি কমানো হচ্ছে। মজুদ সক্ষমতাও পাঁচ হাজার টন থেকে কমিয়ে আনা হচ্ছে। একই সাথে বাতিল করা হচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে দেয়া রয্যালিটিও।
এলপি গ্যাসের সংশোধিত নীতিমালায় এই সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এবিষয়ে অনুমোদনের জন্য চূড়ান্ত খসড়া প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।