এলপি গ্যাসের দাম: অর্ধেকের বেশি কর

বোতল গ্যাস বা তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি)’র দামের অর্ধেকের বেশি কর। তিনদফা ভ্যাট আর মধ্যস্বত্বভোগির লাভ দিয়ে গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে দাম বেড়ে যায় ৬০ভাগের বেশি। বন্দর পর্যন্ত আনতে যে খরচ হয় তার চেয়ে বেশি দিতে হয় কর ভ্যাটসহ অন্যান্য চার্জের জন্য।
সৌদি চুক্তিমূল্য বা সিপি এর সাথে জাহাজ ভাড়া (লোডিং/আনলোডিং খরচ, বন্দর চার্জ, ইত্যাদি), বীমা, কর, শুল্ক ইত্যাদি যোগ করা হয়। এটা বন্দর পর্যন্ত মূল্য। বন্দরের পরে যোগ হয় মজুদ, বোতলজাতকরণ, পরিবহণ, বিতরণ ও বিপণন চার্জ। আর এই সব যোগ করেই হয় ভোক্তার দাম। ভোক্তাকেও শেষে দিতে হয় ভ্যাট বা মূসক।
গেল ডিসেম্বর মাসের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১২ কেজি বোতল গ্যাস বন্দর পর্যন্ত আমদানি করতে খরচ হয় ৬৩০ টাকা। আর ভোক্তা পর্যায়ে পৌছাতে তিনদফা ভ্যাট, করসহ গ্রাহককে দিতে হয় এক হাজার ২৫৯ টাকা।
এলপি গ্যাসের পুরো খরচটা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১২ কেজি গ্যাস কিনতে খরচ হয়েছে ৪৮০ টাকা। এর সাথে মোংলা বন্দর পর্যন্ত পরিবহন খরচ লেগেছে ১২৬ টাকা। আর আমদানি পর্যায়ে কর ও বিভিন্ন চার্জ দিতে হয়েছে ২৪ টাকা। বন্দর পর্যন্ত আসতে মোট খরচ ৬৩০ টাকা।
একবার আমদানিকারক বন্দরে ভ্যাট দিচ্ছে। তারপর কারখানায় বোতলজাত হয়ে বের হওয়ার সময় ভ্যাট দিতে হচ্ছে। আবার যখন গ্রাহক ব্যবহার করছেন তখন ভ্যাট দিচ্ছেন। এভাবে তিনবার প্রত্যেকবার ৫ শতাংশ করে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। ভ্যাট দিতেই মোট খরচে ১৫ শতাংশ যোগ হচ্ছে।
বেসকরারি উদ্যোক্তরা বলছেন, আমদানি করার পর ঐ গ্যাস বোতলে ভরতে খরচ হয় ১১২ টাকা। এতে প্রশাসনিক খরচ ৪৬ টাকা। বিনিয়োগ চার্জ ৪৩ টাকা। বিপণন ৩২ টাকা এবং সরবরাহ খরচ ২৫ টাকা। বন্দর পর্যন্ত আসতে যে ৬৩০ টাকা খরচ হলো তার সাথে যোগ হলো এই ২৫৮ টাকা। এতে মোট খরচ দাঁড়ালো ৮৮৭ টাকা।
এর সাথে বেসরকারি আমদানি কারকরা ৯ শতাংশ লাভ নিচ্ছেন। যার পরিমান ৮০ টাকা। মোট দাড়ালো ৯৬৭ টাকা। এর উপর আমদানিকারককে৫ শতাংশ বা ৪৮ টাকা ভ্যাট দিতে হচ্ছে। এর সাথে যোগ হচ্ছে গ্রাহকের দোর গোড়ায় পৌছানো খরচ ও সরবরাহকারির লাভ, ৫০ টাকা। এই সব খরচের উপর সরবরাহকারিকে ভ্যাট দিতে হচ্ছে ৫ শতাংশ বা ৫৩ টাকা। পরিবেশক থেকে খুচরা বিক্রেতা কিনছেন এক হাজার ১১৯ টাকায়। খুচরা বিক্রেতা লাভ করছেন ৮০ টাকা। আর এবার গ্রাহক সব কিছুর উপর ভ্যাট দিচ্ছেন ৫ শতাংশ বা ৬০ টাকা। সবমিলে ৪৮০ টাকার পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দাম দাঁড়াচ্ছে এক হাজার ২৫৯ টাকা। অর্থাৎ মাঝে লাগছে ৭৭৯ টাকা। যা পণ্যে মূল দামের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন, এলপিজিতে যে ভর্তূকি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে তার চেয়ে ভ্যাট বা কর কমালে দাম কমে যাবে। সকল জ্বালানি পণ্যে এভাবে ভ্যাট নেয়া হয়। যা সরকারের আয়ের একটি উৎস।
বিইআরসি মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ
বোতল গ্যাসের দাম নির্ধারণে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি দাম নির্ধারণের ফর্মূলা বা নিয়ম করার প্রস্তাব করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আমদানি খরচের সাথে যোগ হবে মজুদকরণ ও বোতলজাতকরণ খরচ, তার সাথে যোগ হবে বিতরণ খরচ, স্থানীয় পরিবহন খরচ। পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতাদের খরচ। সব শেষে যোগ হবে মূসক।
এই সব বিষয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, মূল খরচের চেয়ে আনুষঙ্গীক খরচ বেশি।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কারিগরি মূলায়ন কমিটি আন্তর্জাতিক বাজারে উঠানামা বিবেচনায় দেশের বাজারে বোতল গ্যাসের দাম প্রতি মাসে নির্ধারণের সুপারিশ করেছে।
এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণে গণশুনানি শেষ হয়েছে। শুনানিতে এই সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিত প্রস্তাবে
বর্তমানেপ্রতি কেজি এলপি গ্যাস১০৪ টাকা ৯৩ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে নোয়াব। বিইআরসির কারিগরি কমিটি এই দাম ৭২ টাকা ২৪ পয়সা করার সুপারিশ করেছে। ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডার খুচরা পর্যায়ে এক হাজার ২৫৯ টাকা করার প্রস্তাবে কারিগরি কমিটি বলছে ৮৬৬ টাকা। এছাড়া ৩৫ কেজির সিলিন্ডারের দাম ২ হাজার ৫২৫ টাকা এবং ৪৫ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৩ হাজার ২৪৬ টাকা করার প্রস্তাব করেছে কমিটি।
সৌদি আরামকো কোম্পানির সিপি প্রতি টন ৫৩৮ ডলার বিবেচনায় নিলে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম দাঁড়ায় ৯৫৪ টাকা, আর বর্তমান ৩৫৬ ডলার বিবেচনায় নিলে দাম দাঁড়ায় ৭৫৮ টাকা।
মূল্যহার নির্ধারণের প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এলপিজিএল সাড়ে ১২ কেজি দাম ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা প্রস্তাব করেছে।
বিইআরসির কারিগরি কমিটি সারাদেশে একই মূল্যে বিক্রির সুবিধায় এর সঙ্গে ভর্তূকির অর্থ যোগ করে ৯০২ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। তবে ভর্তূকির ৩৩৩ টাকা বাদ দিলে দাম দাঁড়ায় ৫৬৯ টাকা।সরকারি কোম্পানি অবশ্য এই ভর্তূকি মূল্য যোগ না করার পক্ষে মত দিয়েছে।