কুতুবদিয়ার বিচ্ছিন্ন জীবনে গতি আনছে বিদ্যুৎ

বিডিনিউজ :

আইসক্রিম খেতে কেমন, তা জানত না কুতুবদিয়ার কিশোর শাহরুখ। কৃষক মঞ্জুর আলমের হাতে মোবাইল এসেছিল আগেই, কিন্তু বিদ্যুৎ ছিল না বলে চার্জ দিতেও পোড়াতে হত তেল।

বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত কক্সবাজারের এই দ্বীপ উপজেলায় কয়েক মাস হল সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আসছে জাতীয় গ্রিড থেকে। আর তাতেই শাহরুখ, মঞ্জুরদের জীবন পাল্টে যাচ্ছে ‘বিদ্যুৎ গতিতে’।

হাসপাতালে চালু হয়েছে অপারেশন থিয়েটার। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়েও ঝুঁকি নিয়ে প্রসূতিদের আর সমুদ্র পাড়ি দিতে হয় না। প্রসব জটিলতায় সিজারিয়ান অপারেশন হয় এখানেই।

রাতের আঁধারে সড়কে হোঁচট খেয়ে পড়ার দিনও শেষ। সড়ক বাতি মানুষকে সহজে পৌঁছে দিচ্ছে বাড়িতে। বেড়েছে নিরাপত্তা, কর্মঘণ্টা।

সন্ধ্যা হতেই ঘুমের প্রস্তুত হয়ে যেত যে জনপদ, সেখানে এখন গভীর রাত পর্যন্ত চলে আড্ডা। এলাকায় বসেছে ফ্রিজের দোকান। দিনের বাজার দিনে কিনে আনতে হয় না। তাতে বেঁচে যাচ্ছে খরচ।

কৃষি ও মাছ শিকারের ওপর নির্ভর করে চলা জীবনে আসছে পেশার বৈচিত্র্য। বাড়ছে ব্যবসা বাণিজ্য। বসছে নতুন নতুন দোকান। মৎস্যকেন্দ্রিক শিল্প স্থাপনে জমা পড়ছে আবেদন।

চার্জ দিতে সমস্যা দূর হওয়ায় এখন ২৪ ঘণ্টা সচল থাকছে মোবাইল ফোন। ফলে টেলিযোগাযোগ হয়েছে সহজ।

বিদ্যুৎ সুবিধা শিশুদের জীবনে নিয়ে এসেছে ‘আইসক্রিমের খুশি’। অনেকে জীবনে প্রথমবারের মতো উপভোগ করছে মুখরোচক খাবারটি, শুরুতে এর চাহিদাও তাই বেশি। আইসক্রিম বেচে জীবন পাল্টে যাওয়ার কথা বললেন দুই জন ব্যবসায়ী।

বিদ্যুৎ আসার পর আলো ঝলমল করে উঠেছে কুতুবদিয়ার রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়িসহ উপজেলা সদর।

দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে ২০২০ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়।

মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে স্বাভাবিক লাইন নির্মাণের সুযোগ না থাকায় সাবমেরিন কেবল ব্যাবহার করা হয়েছে। আর তাতেই স্বাধীনতার ৫২ বছরে এ দ্বীপ উপজেলার মানুষ প্রথমবারের মত জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের সুবিধা পেয়েছে গত এপ্রিলে।

জীবন কতটা পাল্টাল

কুতুবদিয়া চ্যানেলের মাধ্যমে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ কক্সবাজারের উপজেলা হলেও চট্টগ্রাম থেকেই যোগাযোগ সুবিধাজনক।

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট থেকে বাসে করে চকরিয়া হয়ে মগনামা ঘাটে যেতে হয়। তারপর সেখান থেকে ইঞ্জিন বোটে করে কুতুবদিয়া যেতে লাগে ৪৫ মিনিট। ঝুঁকি নিয়ে স্পিডবোটে গেলে ১৫ মিনিটে যাওয়া যায়।

চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চে করেও সরাসরি কুতুবদিয়া যাওয়া যায়, তাতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগে, সেই লঞ্চ চলে দিনে একবার।

উপজেলা সদর বরঘোপ বাজার হল কুতুবদিয়ার প্রাণকেন্দ্র। সেখানে কথা হল চান্দের গাড়ির চালক নুরুল কালামের সঙ্গে।

কালাম জানালেন, তার বাড়িতে তার টানা হয়েছে, তবে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ লাগেনি। তারপরও তিনি ভীষণ খুশি।

“২০ বছর আগে এখানে সৌর বিদ্যুৎ আসছিল। কিন্তু লাইনের বিদ্যুৎ আসবে কেউ ভাবতে পারিনি। ২০১৪ সাল থেকে শুনতেছি আসবে আসবে, শেষমেশ আমাদের ঘরেও আলো জ্বলবে।”

মনোয়ারখালী গ্রামের কৃষক মঞ্জুর আলম বললেন, “আগে তেল দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে মোবাইল চার্জ দিতাম। তেল না থাকলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে চার্জ দেওয়া লাগত। এখন আমার ঘরেই বিদ্যুৎ আছে।”

আরস সিকদার পাড়ার ৬৪ বছর বয়সী বজল করিমের বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে মাসখানের হলো। তিনি বলেন, “আগে সোলার দিয়ে লাইট জ্বালাইতাম। এখন আমার বাড়িতে রাইসকুকার দিয়ে ভাত রান্না হয়। ফ্রিজ কিনেছি। সমুদ্রের মাছ রেখে খেতে পারি।”

বিদ্যুৎ আসার পর কী কী পরিবর্তন এসেছে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর তাংচংগা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই এলাকার মানুষের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। যেটা আগে ছিল না।

“এখানে এখন দুটো ফ্রিজের দোকান হয়ে গেছে, জমির দাম বেড়ে গেছে। ক্ষুদ্র শিল্প করার দিকে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। মৎস্য ও বরফ শিল্পের অনুমোদনের জন্য যোগাযোগ করছে এখানকার লোকজন।”

উপজেলার বড়ঘোপ বাজারে ব্যবসায়ী জিল্লুর করিম বলেন, “কুতুবদিয়া বিদ্যুৎ আসবে এটা অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু ১২ এপ্রিল রাত থেকে আমরা বিদ্যুৎ পেয়েছি। আমি মনে করি, চট্টগ্রাম শহরের মত এখানে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে।”

খুশির আইসক্রিম

বিদ্যুতের সুবিধার কথা জানতে চাইলে কুতুবদিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির মো. শাহরুখ বলল আইসক্রিমের কথা।

কিশোর জীবনে সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে আসা হয়নি তার। সে কথা জানিয়ে সে বলল, “আমি কখনও ওই পাড়ে যাইনি, আমাদের কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ না থাকায় আইসক্রিম আসত না, আমার সেটা নিয়ে কৌতুহল ছিল। বিদ্যুৎ আসার পর যখন দোকানে আইসক্রিম আসে, তখনই গিয়ে প্রথম খাই। এখন প্রায়ই কিনি।”

কুতুবদিয়ার বিচ্ছিন্ন জীবনে গতি আনছে বিদ্যুৎ
বড়ঘোপ বাজার কলেজের মুদি দোকানি মো. আজিজ মিয়া চাল, চাল, আটা, ময়দারসহ নিত্যপণ্য বিক্রি করে আসছেন। তার দোকানে যে ডিপ ফ্রিজ ছিল, তাতে ছয় ঘণ্টা ঠাণ্ডা করে কোমলপানীয় বিক্রি করতেন এতদিন। এখন সেই ফ্রিজ ঠাসা আইসক্রিমে। বিক্রি হয় দেদার, তাতে কপাল খুলেছে আজিজের।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তিন মাস ধরে আইসক্রিম বিক্রি করছি। প্রথম দিনই ১৭ হাজার টাকার আইসক্রিম বিক্রি করেছি। এখন দিনে সাত/আট হাজার টাকা বিক্রি হয়।

“আগে জেনারেটর দিয়ে ডিপ ফ্রিজে স্পিড, টাইগার, কোকাকোলা, সেভেন আপ বিক্রি করতাম। কারণ ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত। সন্ধ্যা ৬টায় দিলে রাত ১১টা বা ১২টা পর্যন্ত থাকত। এখন ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। আইসক্রিম বিক্রিতেই আমার ভাগ্য ঘুরেছে।”

যেভাবে গেল বিদ্যুৎ

ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ২১৫ দশমিক ৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় প্রায় দুই লাখ মানুষের বসবাস।

এখানে ১৯৮০ সালে জেনারেটরের মাধ্যমে প্রায় ৬০০ গ্রাহককে সান্ধ্যকালীন কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হত। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে যাওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় স্বল্প আকারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করত পিডিবি।

কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী থেকে মগনামা ঘাট পর্যন্ত ৩৩ কেভি রিভার ক্রসিংসহ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সাগরের তলদেশে ফাইবার অপটিকসহ ৫ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সাবমেরিন লাইন নির্মাণের মাধ্যমে কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ দিতে কুতুবদিয়ায় নির্মিত হয়েছে দুই কিলোমিটার বিতরণ লাইন।

চকরিয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও কুতুবদিয়ার আবাসিক প্রকল্প দপ্তরের প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর আগে এ এলাকায় জেনারেটরের মাধ্যমে দিনে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হত, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এই ব্যবস্থা ছিল। এখন ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে মানুষ।”

এখনও সব বাড়িতে সংযোগ লাগেনি। তিন হাজার বাড়ি আর প্রতিষ্ঠানে দেওয়া গেছে লাইন। আরও সাতশ আবেদন হাতে আছে। প্রতিদিনই আলোকিত হচ্ছে নতুন নতুন বাড়ি।

৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ছয়টি ইউনিয়নে বিদ্যুৎ চলে যাবে বলে আশ্বাস দেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা।