কয়লাক্ষেত্র থেকে জ্বালানি গ্যাস আহরণের উদ্যোগ
পেট্রোবাংলা দেশের কয়লাক্ষেত্রগুলো থেকে প্রাথমিক জ্বালানি আহরণের ব্যাপারে উদ্যোগী হচ্ছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত জুন মাসে জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ কয়লাক্ষেত্রের কয়লা না তুলে বাণিজ্যিকভাবে মিথেন গ্যাস আহরণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব সংগ্রহ করা হয়। জুলাই মাসে পেট্রোবাংলা ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মাইনিং অ্যাসোসিয়েটস প্রাইভেট লিমিটেডকে উল্লিখিত জরিপকাজের জন্য নির্বাচন করে। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে জামালগঞ্জ কয়লাক্ষেত্র সম্পর্কে বিদ্যমান তথ্য পর্যালোচনা করে ওই এলাকায় তিনটি কূপ খনন করে কয়লার নমুনা সংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণের পরিকল্পনা করেছে।
জামালগঞ্জ কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় ১৯৬২ সালে। ১১ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ৬১৪ থেকে ১ হাজার ১৫৮ মিটার মাটির গভীরে সাতটি বিভিন্ন পুরুত্বের কয়লার স্তরের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। সম্মিলিতভাবে সাতটি কয়লার স্তরের পুরুত্ব ৬৪ মিটার এবং জ্বালানি কয়লার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫৩ মিলিয়ন টন। পরিমাণের বিবেচনায় জামালগঞ্জ কয়লাক্ষেত্র দেশে আবিষ্কৃত পাঁচটি কয়লাক্ষেত্রের মধ্যে বৃহত্তম। তবে গভীরতা ও আর্থ-কারিগরি সীমাবদ্ধতায় এ কয়লাক্ষেত্র থেকে কয়লা আহরণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায়নি। গত শতকের ষাট ও সত্তর দশকে এ কয়লাক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির খনি নির্মাণ করে কয়লা উত্তোলনের তিনটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছে। প্রথম সমীক্ষা পরিচালনা করে জার্মান প্রতিষ্ঠান ফ্রেইড ক্রুপ রোহস্টাফি। পরে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান পাওয়েল ডাফরিন টেকনিক্যাল সার্ভিসেস লিমিটেড ও রবার্টসন রিসার্চ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড সমীক্ষা পরিচালনা করে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও কারিগরিভাবে খনি নির্মাণ সম্ভব। কিন্তু বিনিয়োগের প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে তুলনামূলক অগভীর বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলে জামালগঞ্জ প্রায় বিস্মৃত বিষয়ে পরিণত হয়। ১৯৯২ সালে অস্ট্রেলীয় প্রতিষ্ঠান বিএইচপি মিনারেলস ভূগর্ভ থেকে কয়লা না তুলে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে মিথেন গ্যাস আহরণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অন্যান্য খাতে জ্বালানি গ্যাস হিসেবে তা ব্যবহারের প্রস্তাব পেশ করে। প্রস্তাবিত নতুন প্রযুক্তি ‘কোলবেড মিথেন’ আহরণ তখন এ দেশে সম্পূর্ণ অজানা। পেট্রোবাংলা বিষয়টি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা স্পষ্ট করতে কয়েক বছর সময় নেয়। তত দিনে বিএইচপি এ খাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। ফলে, জামালগঞ্জের কয়লাসম্পদ আবারও মনোযোগ হারায়।
সম্প্রতি যখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে দেশের ‘অফুরান’ ও যথেচ্ছ ব্যবহারের প্রাকৃতিক গ্যাস দ্রুত ফুরিয়ে আসছে এবং দেশ দ্রুত ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আমদানি জ্বালানিনির্ভর বিকল্পে যেতে বাধ্য হচ্ছে, তখন প্রাথমিক জ্বালানির সম্ভাব্য উৎস হিসেবে কোলবেড মিথেন বা কয়লার গায়ে লেপটে থাকা প্রাকৃতিক মিথেন গ্যাস আহরণের সম্ভাবনা যাচাইয়ের চেষ্টা শুরু হয়েছে। এ জন্য জামালগঞ্জ কয়লাক্ষেত্রের কিছু প্রাকৃতিক সুবিধা, যেমন: পর্যাপ্ত গভীরতা, বড় সঞ্চয় ও পুরু কয়লার স্তরের উপস্থিতি রয়েছে। পূর্ববর্তী সমীক্ষায় কয়লার স্তরে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি জানা গেলেও প্রতি টন কয়লায় কত ঘনমিটার মিথেন রয়েছে বা কয়লার স্তরের ভেদ্যতা ইত্যাদি তথ্য কারও জানা নেই। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জামালগঞ্জ কয়লাক্ষেত্র থেকে মিথেন গ্যাস বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনের উপযোগিতা নিরূপণ করলে (আগামী বছর জুলাই নাগাদ সে সমীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়ার কথা) গ্যাস আহরণের প্রযুক্তি, ব্যয়, সম্ভাব্য উৎপাদন ও ধারাবাহিকভাবে করণীয় নির্ণয়ের জন্য পরবর্তী সময়ে আরও সমীক্ষা দরকার হবে। ইতিবাচক ফল পাওয়া সাপেক্ষে পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগ ও কয়লাক্ষেত্রের মিথেন উত্তোলনের বিষয় জানা যাবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়লাক্ষেত্রের মিথেন গ্যাস আহরণের বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। মিথেন গ্যাস দাহ্য এবং বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বিস্ফোরকে পরিণত হয় বলে ভূগর্ভস্থ খনির অন্যতম অনিষ্টকারী বিপদ হিসেবেই তাকে দেখা হয়। একই সঙ্গে মিথেন অত্যন্ত সক্রিয় গ্রিনহাউস গ্যাস (বায়ুমণ্ডলে ১ অণু মিথেন সমপরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ২০ গুণ বেশি তাপ ধরে রাখে)। মিথেন গ্যাস কয়লার স্তরে প্রায় ৯০ শতাংশ লেপটানো অবস্থায় থাকে বলে তাকে নিঃসরণে বাধ্য করতে কয়লার স্তরে উচ্চ চাপে পানিপ্রবাহের মাধ্যমে যত বেশি সম্ভব ফাটল তৈরি করতে হয়। এ জন্য ভূপৃষ্ঠ থেকে কয়লাক্ষেত্রে অনেক কূপ খনন করে প্রথমে সেগুলোর সাহায্যে উচ্চ চাপে পানি ঢুকিয়ে পরে সেই পানি ও কয়লার স্তরে বিদ্যমান পানি তুলে আনতে হয়। কয়লাক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত পানি খনিজসমৃদ্ধ হওয়ায় সেগুলো পরিশোধনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নইলে পরিবেশের অনাকাঙ্ক্ষিত দূষণ ঘটে। কয়লাক্ষেত্রে খনন করা কূপ এবং কূপসন্নিহিত কয়লার স্তরের আশপাশে বিদ্যমান পানি তুলতে থাকলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, কয়লার স্তরে সৃষ্ট ফাটল দিয়ে সেই পথে ধীরে ধীরে মিথেন গ্যাস উঠে আসে। কোন কয়লাক্ষেত্র থেকে কী পরিমাণ মিথেন গ্যাস উঠে আসবে, তা কয়লায় বিদ্যমান গ্যাস এবং কয়লার স্তরের ভেদ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত। সুতরাং, জামালগঞ্জ কয়লাক্ষেত্রের কোলবেড মিথেনের বাণিজ্যিক উৎপাদন-সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এরপর সামনে আসবে মিথেন গ্যাস আহরণের প্রকল্প বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ।
এদিকে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির সংকুচিত হয়ে আসা কয়লাসম্পদের (প্রাকৃতিক সঞ্চয় নয়, বিদ্যমান খনির মাধ্যমে উৎপাদন-সম্ভাবনা সংকুচিত হয়ে আসছে) কারণে খনির উত্তর ও দক্ষিণাংশের বিদ্যমান সঞ্চিত কয়লা আহরণের সম্ভাবনা যাচাই করতে পেট্রোবাংলা পৃথক প্রস্তাব আহ্বান করেছে। বিদ্যমান ভূতাত্ত্বিক অবস্থা ও বড়পুকুরিয়া খনির বাস্তবতা বিবেচনায় সেখানে ভূগর্ভস্থ বা উন্মুক্ত খনির সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য পেট্রোবাংলার এ উদ্যোগ দেরিতে হলেও কতটুকু কার্যকর হয়, সেটিও দেখার বিষয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির উত্তর ও দক্ষিণাংশের কয়লা উত্তোলনের উপযোগিতা ও উত্তোলন-পদ্ধতি নিরূপণের প্রতিবেদন পেতে আরও প্রায় দুই বছর ধৈর্য ধরতে হবে। দেরিতে হলেও দেশের কয়লা মাটির নিচে ফেলে না রেখে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তার আর্থ-কারিগরি সমীক্ষা শুরু হচ্ছে, এটি ইতিবাচক।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশ-বিষয়ক লেখক।