কয়লা বিদ্যুৎ ও জলবায়ু কূটনীতির ধোঁকা
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের দাবিতে গতকাল শনিবার বিক্ষোভ করেছে পরিবেশবাদীরা, জার্মানির বন শহরে। জলবায়ু সম্মেলনকে সামনে রেখে বন শহরের কেন্দ্রস্থল মুনস্টার প্লাটজে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে বিক্ষোভে অংশ নেয়। আয়োজকদের হিসাবে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ এই বিক্ষোভে অংশ নেয়। অবশ্য বন পুলিশ জানিয়েছে, বিক্ষোভে ১১ হাজারের মতো অংশ নেয়। আমিও গিয়েছিলাম সেই বিক্ষোভ দেখতে। গিয়েছিলাম বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে জানতে, তারা কীভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। বিক্ষোভে দেখলাম, তরুণ-যুবাদের সংখ্যাই বেশি। অবশ্য বয়স্ক নাগরিকেরাও ছিলেন।
বিক্ষোভস্থল মুনস্টার প্লাটজে কথা হলো বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের দাবির সঙ্গে সঙ্গে তারা এও মনে করছে, জলবায়ু সম্মেলন আসলে সাধারণের জন্য কিছু দিতে পারেনি। বাস্তবিক অর্থেই যদি জলবায়ু সম্মেলনের কোনো ইতিবাচক ফলাফল থাকত, তবে আমাদের আজকে এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের জন্য সমবেত হওয়ার দরকার ছিল না। সবুজ দলের কর্মী ইউলিয়া মায়ার মনে করেন, জলবায়ু সম্মেলন আসলে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও এনজিওর টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার সম্মেলনে পরিণত হয়েছে। কীভাবে? প্রশ্ন করতেই ভিন্ন শহর থেকে আসা ইউলিয়া বললেন, দেখো, অভিযোজন, সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, ক্ষয়ক্ষতি বিভিন্ন কথা বলে উন্নত বিশ্ব ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বিভিন্ন সম্মেলনে। কিন্তু সেই অর্থ কি আসলেই সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে। এর বড় একটি অংশ যাচ্ছে এনজিওদের পকেটে। আর একটি অংশ চলে আসে উন্নত দেশেই বিশেষজ্ঞ সেবা দেওয়ার বিনিময়ে। এখন আবার বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে বিমা করতে হবে। যারা ইতিমধ্যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে, তাদের কী হবে? আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামনে কী কী দুর্যোগ আসবে, তা তো আগে থেকেই বলা যাবে না। মোটের ওপর জলবায়ু সম্মেলন আমাদের আদৌ কিছু দিতে পারেনি।
পরিবেশবাদীদের এ ধরনের সমালোচনা ও নেতিবাচক ধারণার মধ্য দিয়েই সোমবার বনে শুরু হচ্ছে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক কনভেনশন ফ্রেমওয়ার্কের (ইউএনএফসিসিসি) ২৩তম সম্মেলন। ১৯৯২ সাল থেকে এই সম্মেলন প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিভিন্ন বছর বিভিন্ন চুক্তি, সমঝোতা হচ্ছে। সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন দেশ ও এনজিও-কর্মীরা নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন। পরের বছর আবার নতুন করে শর্ত যুক্ত হচ্ছে সেই চুক্তি বা সমঝোতায়। ১৯৯৭ সালে যেবার কিয়োটো প্রটোকল গৃহীত হলো, সবাই খুব উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিল যে চুক্তি মোটামুটি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র কার্যত ২০০৮ সাল পর্যন্ত জলবায়ু সম্মেলনে সরাসরি কার্যকর ছিল না। ২০০৯ সালে আবার কোপেনহেগেনে সবাই আশা করেছিল, এবার কিছু একটা হবে। কিন্তু সেবার চীন সামনে চলে এসে সম্মেলনকে ভেস্তে দেয়। যদিও কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড বলে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল বিশ্বনেতৃবৃন্দ। বালি অ্যাকশন প্ল্যান, নাইরোবি প্ল্যাটফর্ম, ডারবার প্ল্যাটফর্ম, কানকুন অ্যাগ্রিমেন্ট—এ ধরনের অনেক চুক্তিই আমাদের সামনে এসেছে এবং আমরা প্রতিবারই আশান্বিত হয়েছি। কিন্তু কার্যকর কোনো ফলাফল আমরা পাইনি। এমন কোনো চুক্তি আমরা দেখিনি, যা ইউএনএফসিসিসি তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বাধ্য করবে সম্পাদিত চুক্তি বাস্তবায়নে।
এটি আসলে ইউএনএফসিসিসির গঠনগত ত্রুটি। ইউএনএফসিসিসির চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো শক্তি নেই। ধারণা করা হয় ১৯৯২ সালে যখন ইউএনএফসিসিসি গঠন করা হয়, তখন ইচ্ছে করেই আইনের দুর্বলতা রাখা হয়েছিল। এখানে আরেকটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে, জলবায়ু, পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদের আসলে মালিকানা কার? রাষ্ট্রের, না জনগণের? অবশ্যই রাষ্ট্রের নয়। জনগণ সার্বভৌম ও সব বিষয়ে মালিকানা দাবি করে। এখন দেখতে হবে, রাষ্ট্র জনগণের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করছে কি না। উন্নত বিশ্ব বা অনুন্নত—সব দেশের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। জলবায়ু কূটনীতিতে বিষয়টি আরও গুরুত্বের দাবি রাখে।
১৯৯২ সাল থেকে যদি সার্বিকভাবে বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যাবে, শুরু থেকেই বিভিন্নভাবে জলবায়ু সম্মেলনে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। সম্ভবত জলবায়ুসংক্রান্ত দর-কষাকষি রাষ্ট্রগুলোর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে কূটনৈতিক তৎপরতার দীর্ঘতমগুলোর একটি। এই দীর্ঘ সময়ে নানা কালক্ষেপণ করে রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে ১৯৯২ সালে যারা উদীয়মান নিঃসরণকারী দেশ ছিল, তারা তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমন্বয় করে নিয়েছে। যেমন: চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা। আবার ওই সময় যারা সর্বোচ্চ গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ ছিল, তারা উঠতি গ্যাস নিঃসরণকারীদের সঙ্গে নিয়ে গ্যাস নির্গমন কমানোর যুক্তি তুলে ধরেছে। এই দুই পক্ষের ঠেলাঠেলিতে পরিস্থিতি আজকে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটি বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার গত ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে। ২০১৬ সালে বিশ্বের বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ গ্যাস জমা হয়েছে, তা পৃথিবীর আট লাখ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। শুধু কার্বন ডাই-অক্সাইডই নির্গত হয়েছে গত ১০ বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। ২০১৬ সালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড মেশার হার হার ৪০৩ দশমিক ৩ পার্টস পার মিলিয়ন। ২০১৫ সালে ছিল ৪০০ পার্টস পার মিলিয়ন। সব থেকে বেশি নিঃসরণ করেছে চীন—১০ হাজার ৩৫৭ টন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ৫ হাজার ৪১৪ টন ও ভারত ২ হাজার ২৭৪ টন নিঃসরণ করেছে। বাংলাদেশে করেছে ৭৭ টন।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার প্রতিবেদন থেকে স্পষ্টতই বলা যায়, জলবায়ুবিষয়ক কূটনীতি শুরু হওয়ার পরও গ্যাসের নিঃসরণ বেড়েছে। বিশাল বিশাল সম্মেলন, আলোচনা, তর্ক, বিক্ষোভ কোনো কিছুই গ্যাস নিঃসরনের গতিকে থামাতে পারছে না। এত অর্থ ব্যয়, জনসমাবেশ করে আমরা কী পেলাম? জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না বিভিন্ন ‘অ্যাক্টর’-এর (রাষ্ট্র ও এনজিও) স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে। বিভিন্ন অ্যাক্টরের বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ রয়েছে। এ নিয়ে আরেক পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করব। তবে পরিশেষে বলা যায়, জলবায়ুবিষয়ক কূটনীতিকে পুরোপুরি ব্যর্থ না বলা গেলেও কোনোভাবেই একে সফল বলা যায় না; যদি গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করাকে আমরা মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করি। একে সফল করতে হলে আমাদের কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় আনতে হবে।
ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি
সৌজন্যে: প্রথম আলো