কয়লা সংকটে পায়রা ও রামপাল

আফরোজা নীলা:

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সংকটের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানির বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
২৩শে এপ্রিল থেকে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ আছে একই কারণে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয় পড়বে। সাধারণ মানুষ যেমন লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়বে এর পাশাপাশি শিল্পকারখানায় ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে।
কয়লা সংকট কেন?
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা আমদানি করা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এই কেন্দ্রে প্রতিদিন ১১ থেকে ১২ হাজার টনের বেশি কয়লা প্রয়োজন।
বর্তমানে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৬ দিনের কয়লা মজুত আছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএম খোরশেদুল আলম জানিয়েছেন, আমদানির বিল বকেয়ার কারণে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘সবসময় ছয় মাসের বাকিতে কেনার চুক্তি হয়েছে। কিন্তু ছয় মাস পরেও বিল দিতে পারছি না। যেমন জানুয়ারিতে যে কয়লার বিল দেওয়ার কথা সেটা জুলাইয়েও করতে পারছি না।’
তিনি বলেন, বকেয়া বিল পরিশোধ করা না গেলে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন বা সিএমসি আর টাকা দেবে না। আর সেটা না হলে কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানও কয়লা সরবরাহ করবে না।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে যৌথ মালিকানায় রয়েছে, বাংলাদেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সিএমসি।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইন্দোনেশিয়ার যে কোম্পানি কয়লা সরবরাহ করে সেই কোম্পানির কয়লার দাম পরিশোধ করে সিএমসি।
অর্থাৎ, সিএমসি কয়লা কেনার ছয়মাস পরে বাংলাদেশ অর্থ পরিশোধ করতে পারবে। এমন বিষয় চুক্তিতে উল্লেখ আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ডলার সংকটের কারণে ছয়মাস পরেও বাংলাদেশ সিএমসিকে অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না।
খোরশেদুল আলম বলেন, ইন্দোনেশিয়া থেকে যে কয়লা কেনা হয় তার বিপরিতে ঋণপত্র খুলে শোধ করছে সিএমসি। ওদেরকে পরে শোধ করা হয়। ডেফার্ড পেমেন্ট, ছয়মাস পরে পরিশোধ করা হয়। অর্থাৎ জানুয়ারিতে যে বিল দেয় সেটা আমরা জুলাইয়ে পরিশোধ করি। চুক্তিটা এমনই। এখন ছয়মাসেও তাদের বিল দিতে পারছি না। ছয়মাসের উপরে আরও পাঁচ মাস চলে গেছে। এখনও সেটা শোধ করতে পারছি না। ডলার সংকটে বকেয়া পরিশোধ করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিল শোধ না করলে তো তারা আর কয়লা দেবে না।
রামপালেও উৎপাদন বন্ধ
কয়লা সংকটের কারণে ২৩শে এপ্রিল থেকে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিটের মধ্যে একটি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন চলছিল। তবে ডলার সংকটের মধ্যে কয়লা আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে উৎপাদন শুরুর ২৭ দিনের মাথায়। পর্যাপ্ত কয়লা না থাকায় ১৪ই জানুয়ারি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ায় এক মাসের মাথায় আবার উৎপাদনে ফেরে কেন্দ্রটি। তারপরও সংশয় ছিল কয়লা আমদানি অব্যাহত থাকবে কিনা। কেন্দ্রটির একটি ইউনিট চালু রাখতে প্রতিদিন প্রয়োজন পাঁচ হাজার টন কয়লা।
আবারও কয়লা সংকটের কারণে এপ্রিল মাসে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
রামপালের জন্যও কয়লা আমদানি করা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হওয়ার প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহেও।
ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারার কারণেই যে কয়লার মজুদ একদম কমে গেছে সে কথাই বারবার বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রয়োজন ডলারের

কয়লার সংকটে বারবার বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া ‘সাংঘাতিক বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিকল্পনাই ছিল এই বছরটায় কয়লার উপর নির্ভরশীল হবো। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি করবো কয়লা দিয়ে।’
কয়লা আমদানি যদি না করা যায় তাহলে গত বছরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করেন ইজাজ হোসেন।
এ বছর বিদ্যুতের চাহিদা গত বছরের তুলনায় বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কয়লা সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হলে এ বছর বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’
‘ঠিকমতো যেন কয়লার যোগান দেয়া যায় সেদিকে সরকারকে ভালভাবে খেয়াল রাখতে হবে। ডলার সংকট হলেও এদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যেটাই কিনি এলএনজি, তেল অথবা কয়লাÑ সবইতো ডলার লাগবে। তাহলে কেন এখানে ডলার সংকট বিশেষ কারণ হবে?’
সবচেয়ে সাশ্রয়ী জ্বালানি ক্রয়ের দিকে জোর দেয়া উচিৎ বলে মনে করছেন তিনি।
বিদ্যুৎ উৎপাদন যদি ব্যাহতও হয় তাহলে তার প্রভাব যেন রপ্তানিমুখী শিল্পে না পড়ে সেদিকে নজর রাখা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডলারের ঘাটতি বাংলাদেশের জন্য একটি ‘উভয় সংকট’ তৈরি করেছে। ডলার সাশ্রয় করতে গিয়ে কয়লা আমদানি কম হচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিল্প খাতে। রপ্তানিমুখি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে ডলারের যোগানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইজাজ হোসেন বলেন, ‘আমাদের বেশিরভাগ শিল্প রপ্তানির জন্যই চলে। আমাদেও রপ্তানিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে ডলার বাঁচালাম ওদিকে ডলার কমে গেল তাহলে তো লাভ হলো না -এটা মনে রাখতে হবে।’
সরকার কী বলছে?
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান বলেছেন, এই সমস্যার দ্রুত সমাধানে তারা তৎপর আছেন। বিদ্যুৎ উৎপাদন যেন ব্যাহত না হয় সেজন্য যে উদ্যোগ নেয়া দরকার তা নেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, কয়লার সরবরাহ নিশ্চিত হবে সেজন্য কাজ করছি। রামপালের কাজ শুরু হবে। একটা কেন্দ্রে শুরুর দিকে সমস্যা থাকে। কয়লার ব্যবস্থাও হয়েছে।’
পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে কয়লার মজুত আছে তা থাকতে থাকতেই যেন কেন্দ্রে কয়লা আমদানি শুরু হয় তা নিয়েও কাজ চলছে বলে তিনি জানান।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম এমন ১৫৪টি কেন্দ্র রয়েছে। যার মধ্যে বেশিরভাগই ভাড়ায় চালিত ডিজেলভিত্তিক।
গত বছর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ফলে গত বছর গরমে লোডশেডিংয়ের ভোগান্তির মধ্যে পড়েছিল মানুষ। এমনকি শীতকালেও লোডশেডিং হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়।
বিশেষেজ্ঞরা মতে, এ বছর গরম আসতে না আসতেই যে কয়লা সংকটের মুখে পড়েছে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তাতে সামনে বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হতে পারে।
ডলার সংকটের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ খাতে। কারণ, কয়লা হোক আর তেল হোক- বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল জোগাতে প্রয়োজন ডলার।
বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএম খোরশেদুল আলম বলছেন, কয়লা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা নিশ্চয়ই করছে সরকার।


বিবিসি বাংলা