খরচ বাড়েনি তবু বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ

বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বাড়েনি। বরং কমেছে। তবু নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গত দুই বছর নতুন কোন বাড়তি দামের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে যোগ হয়নি। উৎপাদনে আসেনি নতুন বিদ্যুৎ। ফলে উৎপাদন খরচও বাড়েনি। জ্বালানি তেল আমদানিতেও খরচ বাড়েনি। বরং কমেছে। কারণ বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে। কিন্তু আগে থেকেই যে দাম বেড়ে আছে সেই ভর্তুকি পুরণ করতেই আবার দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।
ভাড়ায় আনা বেশি দামের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগেরই মেয়াদ শেষ হয়েছে। মেয়াদ শেষ হয়ে আবার নতুন করে চুক্তি করা হয়েছে। নতুন করে চুক্তি করার পরে স্বাভাবিক ভাবেই দাম কমেছে। সেক্ষেত্রে পিডিবির বিদ্যুৎ কিনতে খরচও কমেছে। একদিকে পিডিবির খরচ কমেছে অন্যদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম। এই অবস্থায় সামগ্রীকভাবে পিডিবি’র খরচ অনেক কমেছে। একদিকে কিনতে হচ্ছে আগের চেয়ে কম দামে অন্যদিকে তাদের যে তেল সরবরাহ করা হত সেখানেও সরকারের ভর্তুকি লাগছে কম। এই দুই মিলে খরচ অনেক কমে গেছে। তবু যেটুকু ভর্তূকি আছে তাও আর দিতে সম্মত হচ্ছে না। এজন্যই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হচ্ছে বলে ইতিমধ্যে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পাইকারি পর্যায়ের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এমাসের মধ্যেই খুচরা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব যাবে। এর সাথে সাথেই অন্য বিতরণ কোম্পানিগুলোও গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে। কারণ পাইকারি দাম বাড়ালেই খুচরা পর্যায়ে বাড়াতে হবে।

power 2
বিদ্যুৎ জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে এনার্জি বাংলাকে বলেন, পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি। বিইআরসি পর্যালোচনা করে এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে তবু বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুধু তেল দিয়ে তো আর বিদ্যুৎ হয় না। গ্যাস দিয়েও হয়। এখনও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। আমরা ভর্তুকি কমানোর জন্য দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আস্তে আস্তে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। উৎপাদন খরচের সমান করা হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম বিভাগের অধ্যাপক সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম এনার্জি বাংলাকে বলেন, এই মুহুর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোন যুক্তি নেই। জাতীয় বাজেটে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে সাথে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। এই দুটো বিষয় এক করলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা থাকে না। তিনি বলেন, পিডিবি বলছে, তাদের উৎপাদন খরচ হচ্ছে প্রতি ইউনিট ছয় টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু বিক্রি করছে চার টাকা ৬৭ পয়সা। এই পার্থক্য পুসিয়ে নিতে বাজেটে ভর্তুকি রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি খরচ তেলে। কিন্তু বিশ্বে তেলের দাম কমেছে। ব্যারেল প্রতি একশত টাকার বেশি ছিল এখন তা ৮০/৮৫ টাকায় নেমে এসেছে। খরচ বাড়ার কোন কারণ দেখি না। তিনি বলেন, শুনানীতে এইসব বিষয়গুলো পর্যালোচনা হবে। ক্যাব এর উচিত হবে এসব বিষয়গুলো উপস্থাপন করা। দাম না বাড়ানোর জন্য চাপ দেয়া।
পিডিবি চেয়ারম্যান আবদুহু রুহুল্লাহ বলেন, লোকসান যা আছে সেখানেই অনেক ভর্তহৃকি লাগছে। লোকসান মেটাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া কোন উপায় নেই। উৎপাদন খরচ মেটাতে পাইকারি মহৃল্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। খুচরাটা দেয়া হবে।
কম দামের বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। উন্নুয়ন হয়নি বিতরণ ব্যবস্থার। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও চাহিদার তুলনায় তা কম। ফলে সেবার মান অথৈবচ। ২০১৪ সাল থেকেই পর্যায়ক্রমে বিদ্যুতের দাম কমানোর কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি বরং আবার দাম বাড়াতে হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ছে ঠিকই কিন্তু সেবা বাড়ছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়তই আয় ব্যয় সমন্বয় করতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিচ্ছে। দাম বাড়ছেও।
অব্যবস্থাপনা, সিদ্ধান্তহীনতা আর যথাযথ উদ্যোগের অভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো থেকে বের হয়ে আসা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও তা হয়েছে উচ্চমুল্যের। আবার যে উৎপাদন বেড়েছে অথনৈতিক কারণে তার পুরো সুফল পাওয়া যায়নি। উৎপাদন খরচ বেশি বলে সারাবছর বেশিরভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বল্পব্দ রাখতে হয়েছে বা হচ্ছে। এতে বিনিয়োগ হলেও, বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মত ক্ষমতা থাকলেও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। একই সাথে বাড়েনি সেবাও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দাম বাড়ছে ধাপে ধাপে। কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। এখনও আগের মতই লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও চাহিদাও বেড়েছে সমান তালে। চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে উৎপাদন বেড়েছে অনেক কম। যার কারণে ভোগান্তি কমেনি।
তেল চালিত ভাড়ায় আনা কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য উৎপাদন খরচ হচ্ছে গড়ে ১২ থেকে ১৫ টাকা। কিন্তু এই তেল চালিত বড় স্থায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে তাতে উৎপাদন খরচ পড়ত গড়ে আট টাকারও কম।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম এনার্জি বাংলাকে বলেন, সরকারের অদক্ষতা, ভুলনীতি এবং দুনীতির কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। বিভিল্পু জায়গাতে প্রয়োজনের তুলনায় খরচ বাড়ানো হয়েছে। বহু সুচক ছিল যেখানে খরচ কমানো যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। এসব কারণে ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। একটি গণতান্ত্রািক সরকারের কাছে এটা কাম্য নয়। এতে সরকার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। সরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ না করে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে একই গ্যাস দিয়ে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে কম দামে গ্রাহকরা বিদ্যুৎ পেত।

power 3
স্থায়ী বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অনেক চুক্তি হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়েছে অনেক কম। উৎপাদনে আসাতো দুরে থাক বিন্দুমাত্র কাজই করতে পারেনি অনেকে। এজন্য বিদ্যুতের দামও কমানো যায়নি।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে কোন কাজ করতে না পারায় সরকারের লক্ষ পুরণ এখনই হোঁচট খেয়েছে। গত কয়েকবছর সরকারের সাথে চুক্তি হওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৫/১৬ সালের মধ্যে যেসব কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা এমন অনেক কেন্দ্রর এখনও কোন কাজই শুরু হয়নি। এমনকি ২০১৪ সালে উৎপাদনে আসার কথা ছিল যেসব কেন্দ্রর তারও অগ্রগতি শুন্য। ২০১৭ সালের মধ্যে উৎপাদন করার অঙ্গিকার করে সাত হাজার ৩০৮ মেগাওয়াটের চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু এরমধ্যে তিন হাজার ৯২৯ মেগাওয়াটের কাজই শুরু করতে পারেনি। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রর অর্থ সংস্থানও হয়নি। এরমধ্যে সরকারি প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট। বাকীটা বেসরকারি। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত জাতীয় গ্রীডে মোট যোগ হয়েছে পাঁচ হাজার ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
২০০৯ থেকে ২০১৪ মে পর্যন্ত ১০ হাজার ৮৯৯ মেগাওয়াটের ৭৫টি কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হয়েছে। এরমধ্যে ৪০টি কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে যার উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার ৫৯১ মেগাওয়াট।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেবা বাড়ছে না। সেবা বাড়ানোর জন্য বিইআরসি আইনের অনুচ্ছেদ তিন অনুযায়ি নির্দেশনাও দিচ্ছে বিইআরসি। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দাম বাড়ানোর সময় প্রতিবারই এই নির্দেশনা দিয়ে থাকে। কিন্তু তা পালন হয় না। কখন লোডশেডিং হবে তা মানুষ জানতে পারেনা। বিদ্যুৎ বিল নিয়ে ভোগান্তি আছে। ভেজাল বিদ্যুতে (লোভোল্টেজ) যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে। এসব উন্নয়নে নানা কার্যক্রম আছে বিতরণ কোম্পানিগুলোর। কিন্তু তবু সেবার ক্ষেত্রে তার ফল দেখা যাচ্ছে না।
বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে বছরে দুই হাজার ৬২ কোটি টাকা আয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এরমধ্যে আরইবি ৬৩২ কোটি, পিডিবি ৭২৪ কোটি, ওজোপাডিকো ১০৭ কোটি, ডেসকো ২৫০ কোটি এবং ডিপিডিসি’র ৩৪৯ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরে বিদ্যুৎখাতে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। এ বছরও সমপরিমাণ ভর্তুকি দিতে হতে পারে।
গত ১৩ই মার্চ বিদ্যুতের দাম গড়ে ছয় দশমিক ৯৬ শতাংশ বা সাত শতাংশ বাড়ানো হয়। প্রতি ইউনিটে দাম বাড়ানো হয় ৪০ পয়সা। গতবারই প্রথম প্রথম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। একই সাথে বাড়েনি কৃষিসেচ যন্ত্রের বিদ্যুতের দাম। এরআগে ১লা সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। ২০০৯ সাল থেকে এপর্যন্ত সাতবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।