গরমের আঁচ বিদ্যুতে; চাহিদা বাড়ছে, গ্রাম ভুগছে
নিজস্ব প্রতিবেদক/ বিডিনিউজ:
বিদ্যুতের উৎপাদন ও আমদানি বাড়িয়েও লোড শেডিংয়ের যন্ত্রণা শেষ হচ্ছে না; বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের গ্রাহকদের বরাবরের মতই ভুগতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
টানা তাপদাহে দেশজুড়ে গরমের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা ও যোগানের পার্থক্যও বাড়ছে গত কয়েকদিন ধরে। এর প্রভাবও বেশি পড়ছে গ্রামীণ ও পল্লী এলাকাতে। বিদ্যুতের জন্য হাহাকার থেকে কেন্দ্রে হামলা, মিছিল বের করার খবর এসেছে।
মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে দিনে ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। রোজার মধ্যে সেহরি ও ইফতারের সময়েও অনেক এলাকার বাসিন্দারা লোড শেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়ছেন।
তীব্র তাপপ্রবাহ সেই দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। তপ্ত আবহাওয়ায় পুড়তে থাকার এসময়ে চৈত্রের শেষ দিন থেকে একের পর এক দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ডও হচ্ছে। গত সোমবার দেশে পাঁচ দশকের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হয়েছে পাবনার ঈশ্বরদীতে।
আগের দিন রোববার ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
মঙ্গলবার দেশজুড়ে তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও তীব্র গরমে পুড়ছে জনজীবন। এরই মধ্যে বিদ্যুতের ঘন ঘন আসা-যাওয়া শিশু, বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষকে অতিষ্ট করে তুলেছে। তবে লোড শেডিংয়ের এ যন্ত্রণা নগরের চেয়ে বেশি গ্রামে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গত এক সপ্তাহের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাপদাহ বাড়ার সঙ্গে গত এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ফলে রেকর্ড সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও চাহিদা মিটছে না; লোড শেডিং করতে হচ্ছে।
এর মধ্যেই কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অনেকগুলো ছোট-বড় কেন্দ্র গ্যাস ও জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুতের যোগান ও চাহিদাতে সেটিও প্রভাব ফেলছে।
রোজা ও গরমের মধ্যে এমন পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান।
সরকারি ছুটি, রামপাল পুনরায় চালু ও গরম কমে আসার ওপর ভরসা রেখে আগামী দুই এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বস্তিকর হবে বলে আশা করছেন বিদ্যুৎ সচিব।
দেশে বিদ্যুতের বর্তমান চাহিদার চেয়েও উৎপাদন সক্ষমতা বেশি হওয়ার পরও তা কেন কাজে লাগানো যাচ্ছে না জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে উৎপাদন সক্ষমতার শতভাগ একই সঙ্গে কাজে লাগানো যায় না। রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য প্রয়োজনে চাহিদার চেয়ে ৫০ ভাগ বেশি উৎপাদন সক্ষমতা রাখতে হয়। কারণ, একসঙ্গে সক্ষমতার সবটুকু সচল থাকবে এটা বাস্তব সম্মত নয়।
দেশে স্থাপিত ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫০ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। গত কয়েকদিন ধরে চাহিদা বাড়তে থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনেও রেকর্ড হচ্ছে। তবে এরপরও চাহিদা ও যোগানের মধ্যে বড় ব্যবধান থাকায় লোড শেডিং করতে হচ্ছে।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এক বছর আগের তুলনায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট। ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিলে বিকালে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪,৭৮২ মেগাওয়াট, যা তখন উৎপাদন করে পূরণ করা গেছে। এক বছরের মাথায় সেই চাহিদা বেড়ে ১৬,০০০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।
চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল রোববার আমদানি ও উৎপাদন মিলিয়ে ১৪ হাজার ৮৪৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত উৎপাদন করা গেছে। সেদিন দেশজুড়ে ১২০০ থেকে ১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল বলে পিডিবি দাবি করছে।
তবে সারাদেশে যে পরিমাণ লোড শেডিং হচ্ছে সেগুলোর অধিকাংশই হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সমিতিগুলোর অধীনে।
পল্লী বিদ্যুতের ৮০টি সমিতির অধীনে প্রায় তিন কোটি গ্রাহকের জন্য গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গড়ে দৈনিক প্রায় নয় হাজার মেগাওয়াট করে বিদ্যুতের প্রয়োজন হচ্ছে। এর বিপরীতে যোগান দেওয়া যাচ্ছে সাত হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার সময় আরইবির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হিসাবে দেখা যায়, বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৯ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। এসময় সরবরাহ করা হয় ৭ হাজার ৭৩ মেগাওয়াট। চাহিদার বাকি প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট ওই সময়টাতে লোড শেডিং হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দিনের বেলায় বেলা ১২টার দিকে চাহিদা ও যোগানের ব্যবধানের আরও বাড়ে। কারণ সেই সময় বিদ্যুতের উৎপাদন কম থাকে। দিনের বেলা আট হাজার মেগাওয়াট ও রাতে নয় হাজার মেগাওয়াট চাহিদা থাকে। কিন্তু দিনে উৎপাদন কম থাকায় লোড শেডিং করতে হয় বেশি। গত এক সপ্তাহ ধরে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াটের ব্যবধান থাকছে বলে তিনি জানান।
সীমাহীন ভোগান্তি
তীব্র গরমের মধ্যে টানা দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকার যন্ত্রণায় নগরের চেয়ে বেশি ভুগছে গ্রামের মানুষ।
লোড শেডিংয়ের দুর্ভোগে অতিষ্ঠ হয়ে সোমবার রাতে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের একটি শাখা অফিসে হামলা চালিয়েছে স্থানীয়রা। সেখানে দৈনিক ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোড শেডিং হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ।
এলাকাবাসী হামলা করেছে ফুলগাজী উপজেলার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে। সেখানে ইট- পাটকেল নিক্ষেপ করেছে ‘বিক্ষুব্ধ’ গ্রাহকরা।
এই দুই ঘটনার পর ছাগলনাইয়ায় হামলার ঘটনার পর থেকে সোনাগাজীর পল্লী বিদ্যুৎ অফিসগুলো পাহারা দিচ্ছে ছাত্রলীগ।
অপরদিকে হবিগঞ্জ সদরে টানা লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে শহরবাসী। গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে সোমবার দুপুরে শহরের আরডি হল প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার শহরতলীর বাসিন্দা জান্নাত চামেলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দিনে ও রাতের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ না থাকার কারণে তার বৃদ্ধ মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তারা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বসবাস করলেও এসময়ে একটু স্বস্তির জন্য নিচ তলায় এসে অবস্থান নিয়েছেন। তবে বিদ্যুৎ না থাকায় অস্বস্তি আরও বেড়েছে। গত দুই দিন ধরে ভোর রাতে সেহরির সময়ও বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
একই অভিযোগ করেন নোয়াখালী সদরের বাসিন্দা গৃহিণী সাহিদা আক্তার ও বগুড়া সদরের বাসিন্দা সাদিক রেজা। বগুড়ায় গত দুই তিন ধরে এবং নোয়াখালীতে গত এক সপ্তাহ ধরে দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না বলে তাদের অভিযোগ।
বন্ধ হয়ে আছে রামপাল
কয়লার স্বল্পতা না থাকলেও দেশের অন্যতম বৃহৎ রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কারিগরি ক্রুটির কারণে গত দুইদিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামতের জন্য বন্ধ হয়ে আছে। জ্বালানি ও গ্যাস সংকটের কারণেও উৎপাদন হচ্ছে না অনেকে কেন্দ্রে।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে স্থাপিত ১৫০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ও ভারত থেকে আমদানি মিলিয়ে দৈনিক ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এর বাইরে ভারতের ঝাড়খণ্ডে আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে।
গত দুইমাস ধরে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৬০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ আসলেও দুই দিন ধরে তা বন্ধ হয়ে আছে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে।
অপরদিকে পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র থেকে দৈনিক ১২৪৪ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।
চাহিদা ও ফারাকের বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, “আমাদের ধারণা ছিল এই বছর হয়তো বিদ্যুতের চাহিদা ১০ শতাংশ বাড়বে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তীব্র গরমের কারণে চাহিদা বেড়েছে আরও বেশি।
পাশাপাশি তাপদাহের কারণে তাপমাত্রাও কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, যা বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে। সব মিলিয়ে আগামী দুই এক দিনের মধ্যে লোড শেডিংয়ের সংকট কমে আসবে।
প্রতিমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ
এদিকে রোজার মাসে লোড শেডিংয়ের জন্য গ্রাহকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ফেইসবুকে বার্তা দিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
সেখানে তিনি লেখেন, “এ বছর গ্রীষ্ম, সেচ মৌসুম ও রোজা একসঙ্গে হওয়াতে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছবে সেটা আমরা আগেই ধারণা করেছিলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা আমাদের পূর্ব প্রস্তুতির স্বাক্ষরও রেখেছি। কিন্তু গত ৫০ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙ্গে বর্তমানে যে নজিরবিহীন দাবদাহ চলছে তাতে ধারনার চেয়েও বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। ফলে দেশের অনেক জায়গায় লোড শেডিং করতে হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ভোগের জন্য আমরা আন্তরিক সহমর্মিতা ও দুঃখ প্রকাশ করছি।”