গ্যাসের বায়বীয় গল্প
গল্পটা বুধবারের। দেশে গ্যাসের উৎপাদন ২৬৩ কোটি ৯০ লাখ ঘনফুট। সরকারী তিন কোম্পানীর ৭০ এবং বিদেশী কোম্পানীর ৪৩টা গ্যাসকুপ থেকে উত্তোলন করা হয়েছে এই গ্যাস। কুপের সংখ্যায় বেশি হলেও, ৬০ শতাংশই উত্তোলন করে বিদেশী দুই কোম্পানী শেভরন (৫৭.৩%) আর তাল্লো। এই গ্যাসের সিংহভাগ ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ৬২ টা বিদ্যুৎকেন্দ্রে দৈনিক চাহিদা ১৮৪ কোটি ১০ লাখ ঘনফুট। গ্যাসের অভাবে ১৫ টা পুরোপুরি বন্ধ এবং ১০টার মতো অর্ধেক লোডে চলেছে। তাতে ৮ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুট ব্যবহার হচ্ছে। ঘাটতি প্রায় ১০ কোটি ঘনফুট। সাত সার কারখানার চাহিদা ৩০ কোটি, শুধু কাফকো ছাড়া সব বন্ধ। গ্যাসের অভাবে সরবরাহ ৭ কোটি, ঘাটতি ২৩ কোটি ঘনফুট। এছাড়া ক্যাপ্টিভ, শিল্প, চা, সিএনজি, গৃহস্থালী খাতে আকাশ ছোয়া চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হয়েছে ১৬ কোটি ৯০ লাখ ঘনফুট।
সরকারী ছয়টি গ্যাস বিতরনকারী কোম্পানীর হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৪৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে গৃহস্থালী খাতে, ছয়টা কোম্পানীর গৃহস্থালী (সব মিটারবিহীন) সংযোগ ৪১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৬৪। এখানে একটা বিরাট গোজামিল পরিলক্ষিত হয়। একটা সংযোগের বিপরীতে গড়পড়তা হিসেব করলে এর পরিমান ১ কোটি ২৫ লাখ ঘনফুট এর বেশী হবার কথা না। ধরে নেই মানুষ চুলা বন্ধ করে না (যদিও প্রায় সবখানে গ্যাসই থাকে না তাই চুলা বন্ধ আর খোলা একই ব্যাপার)। এবং অবৈধ সংযোগের পরিমান প্রায় অর্ধেক। তাতে করেও এই খরচের পরিমান ২ কোটি ২০ লাখ ঘনফুটের বেশি হবার কথা না। তাও ধরে নিলাম এটাই ব্যবহার হচ্ছে গৃহস্থলীতে। তাহলেও ২ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট গ্যাসের খবর এখনোও লাপাত্তা।
লক্ষ করে দেখুন সার কারখানার ঘাটতি ২ কোটি ৩০ লাখ এবং গৃ্হস্থালী খাতে হিসেব নাই ২ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট গ্যাসের। সংখ্যাটা কাকতলীয় ভাবে মিলে গেলেও বাস্তবে প্রায় কাছাকাছি।
সাতটা সার কারখানা গ্যাসের অভাবে বন্ধ থাকায় দৈনিক প্রায় ১০ হাজার টন ইউরিয়া উৎপাদন বন্ধ হয়ে আছে। যা আমাদের আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৪০০ ডলার/টন ইউরিয়া কিনে আমাদের ১৬ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ কারখানাগুলো সচল করলে প্রায় ১২-১৩ টাকা কেজিতে সার উৎপাদন সম্ভব হতো। কারখানা বন্ধ করে, নির্ধারিত খরচ দেয়া ছাড়াও শুধু ইউরিয়া আমদানিতেই দৈনিক ২০ কোটি টাকা ক্ষতি করছে বিসিআইসি। সর্বসাকুল্যে গ্যাসের অভাবে বন্ধ থাকা সার কারখানা গুলো চালিয়ে এক মাসে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি গুনছে সরকার।
বর্তমানে সংযোগ থাকা গৃহস্থালীতে গ্যাস সরবরাহ করেও লাপাত্তা হয়ে যাওয়া সেই গ্যাস দিয়ে হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হতো। যদি শুধু বিতরণ ও সঞ্চালনের সমস্যা মেটানো যেত সেখানে নজরদারির পরিমান বাড়ানো যেতো, তাহলে অন্যরকম হতো।
এই অংকের গোজামিল আর কতদিন চলবে? ক্ষতির সাগরে ডুবতে ডুবতে এভাবেই নিমজ্জিত হয়ে যাবো একদিন আমরা? এর শেষ কোথায়?
লেখক, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ