গ্যাস উৎপাদন ও বাপেক্স: কিছু কথা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাপেক্সের আলাদা পে স্কেল গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় বাপেক্সের পে স্কেল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর অধীন কোম্পানির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়। বাপেক্স বোর্ড পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষা করে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে অনুমোদনের জন্য পাঠায়।
প্রধানমন্ত্রী সেই নির্দেশনা দিয়েছিলেন ২০১০ সালে। এর আরও পরে একাধিক সভায় যখন কাজের তাগিদে দেশের একমাত্র তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্সের জন্য খননযন্ত্র কেনার বাস্তবতা তৈরি হয়, তখনও প্রধানমন্ত্রী বাপেক্সের জন্য আলাদা বেতন স্কেলের অগ্রগতি জানতে চেয়েছেন। কেন সেটা হয়নি, সে আলোচনা পরে। কারণ এখনকার বাস্তবতা হলো, পে স্কেল দূরে থাক, সেই বাপেক্সকে আজ প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত করা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে, বাপেক্স আজ দুর্নীতিগ্রস্ত। এদের দিয়ে সুষ্ঠুভাবে কোনো খনন কার্যক্রম বা সাইসমিক সার্ভে কার্যক্রম করা সম্ভব নয়।
মালিবাগের মোড়ে ছিল বাপেক্সের প্রধান অফিস, যা ছিল জরাজীর্ণ। সেই অফিস থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে বাপেক্স শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হয়েছিল। মৃতপ্রায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রের কূপে ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি, বেশ কিছু উন্নয়ন কূপ খনন করে নতুন কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কারের মাধ্যমে দেশের গ্যাস সংকট নিরসনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ইতিপূর্বে বাপেক্স ৩৫ বছরের পুরনো ড্রিলিং রিগ দিয়ে গ্যাস কূপের ওয়ার্কওভার কার্যক্রম এবং ২৩ থেকে ২৬ বছরের পুরনো ড্রিলিং রিগ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করত। এরপর এ সরকারের হাতেই বাপেক্সকে শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হয়। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কার্যক্রমে এবং ২ডি ও ৩ডি সাইসমিক সার্ভে প্রসেসিং ও ইন্টারপ্রিটেশনের কাজে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার, ড্রিলিং রিগ ক্রয় ও ব্যবহার করা হয়।
সীমিত আর্থিক সুবিধার মধ্য থেকেই বাপেক্স ২০০৯ থেকে ২০১৩ সময়কালে বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে ১৪টি কূপে ওয়ার্কওভার করে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, চারটি উন্নয়ন কূপ খনন করে ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং চারটি অনুসন্ধান কূপ খনন করে দুটি গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কারের মাধ্যমে ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অর্থাৎ মোট ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করে দেশের গ্যাস সংকট মোকাবেলায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এর সূত্র ধরেই বাপেক্সের পে স্কেল আন্তর্জাতিক মানের করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সভায় নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু বড়ই অনুতাপ ও দুঃখের বিষয় হলো, সে সময় ওই বিভাগে কর্মরত দুই-একজন নেতিবাচক কর্মকর্তার কারণে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। পে স্কেল অনুমোদনের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় প্রেরণ করা হয়, যখন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব দেশের বাইরে ছিলেন। যে সভায় প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ ছিল না চেয়ারম্যান, পেট্রোবাংলা বা বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের।
পরবর্তীকালে ২০১৫ সালে বাপেক্সের জন্য একটি অবাস্তব এবং অযৌক্তিক কূপ খনন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে ছিল ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৫৩টি অনুসন্ধান কূপ, ৩৫টি উন্নয়ন কূপ এবং ২০টি কূপের ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করার পরিকল্পনা। যে প্রক্রিয়ায় বিদেশি ড্রিলিং কোম্পানি নিয়োগে ছিল না কোনো স্বচ্ছতা। বাপেক্সকে দিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করা হলো। কিন্তু তা কি সম্ভব ছিল? না ছিল বাস্তবসম্মত কোনো পরিকল্পনা? কেননা অদ্যাবধি বাপেক্সসহ বিভিন্ন বিদেশি তেল কোম্পানি স্থলভাগে বিগত প্রায় ১১০ বছরে মোট ৬৪টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে। সেখানে বাপেক্স এবং বিদেশি ড্রিলিং ঠিকাদার নিয়োগ করে পাঁচ বছরের মধ্যে ৫৩টি অনুসন্ধান কূপ খনন করবে, এটা কি আকাশকুসুম কল্পনাপ্রসূত রূপরেখা নয়? এত বিশাল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার মতো অভিজ্ঞ জনবল বাপেক্সের ছিল কি? অথবা আছে কি? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাপেক্সে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার মতো ম্যানেজমেন্ট আছে কি? অবশ্যই ছিল না বা নেই। তাহলে বাপেক্সকে দিয়ে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলো কেন? এ সময়কালে বিদেশি ড্রিলিং ঠিকাদার নিয়োগ করেও মাত্র ৬টি অনুসন্ধান কূপ ও দুটি উন্নয়ন কূপ খনন করা হয়। এ ব্যর্থতার দায়ভার শুধু কি বাপেক্সের? আজ বিভিন্নভাবে প্রচার করা হচ্ছে, বাপেক্স একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। থ্রিডি কার্যক্রম পরিচালনায় টেন্ডার ছাড়া শত শত কোটি টাকার কাজ দেওয়া হচ্ছে। বাপেক্সকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে কার স্বার্থে? গত প্রায় ৩০ বছর ধরে বাপেক্স তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাপেক্স সীমিত সম্পদ এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও নিজস্ব কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে দেশের জ্বালানি সংকট নিরসনে প্রভূত অবদান রেখে চলেছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাপেক্স এখনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
প্রায় চার বছর বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, সরকারিভাবে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হলে পুনরায় উজ্জীবিত হওয়ার সব সক্ষমতা বাপেক্সের এখনও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একান্ত অনুরোধ, তিনি যেন বাপেক্সকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে না আসেন। সঠিক ব্যবস্থাপনায় বাপেক্সকে কার্যকর করে এর বিপুল কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করেন। দেশের স্বার্থেই বাপেক্সকে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর কোনো বিকল্প নেই।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাপেক্স