গ্যাস নেই তবুও পাইপ

বিদ্যুতের খুঁটির মত শুধু আশা দিয়েই গ্যাস পাইপ বসানো হচ্ছে। আদৌ গ্যাস দেয়া হবে কিনা তার ঠিক নেই। কবে কোথা থেকে কোন গ্যাস যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। তবু হাজার কোটি টাকা খরচ করে হাজার কিলোমিটার পাইপ বসানো হচ্ছে। এটা খুলনাঞ্চলের কথা।
খুলনায় গ্যাস যাওয়া সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তবু সেখানে গ্যাস নিতে সঞ্চালন পাইপ বসানোর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। শুধু পদ্মা নদীর অংশটুকু বাকী। বিতরণ লাইন করার জন্য প্রয়োজনীয় পাইপ আমদানি করা হয়েছে। খুলনা শহরের আবাসিক এলাকায় ৮৪৫ কিলোমিটার পাইপ বসানো হচ্ছে। খুলনার সোনাডাঙ্গা এলাকায় ২৫ বিঘা জমি ভাড়া নিয়ে পাইপ আমদানি করে মজুদ করা হয়েছে। অল্প কিছু মালামাল আমদানি বাকি আছে। সেটা এলেই খুলনা শহরে বিতরণ লাইন বসানোর কাজ শুরু হবে। পাইপ বসানোর ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। সঞ্চালন লাইনের জন্য ৭২৬ কোটি এবং সরবরাহ লাইনে (এখন পর্যন্ত) ৬০০ কোটি, সব মিলে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এই অর্থের সিংহভাগ ইতিমধ্যে খরচ হয়েছে। কুষ্টিয়া, যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনা ও বাগেরহাটবাসীকে শুধু আশা দিয়ে পাইপ বসানোর কাজ চলছে। কিন্তু সেখানে গ্যাস কবে যাবে তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউ।
বর্তমানে যে সব এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে সেখানেই প্রয়োজন মেটানো যাচ্ছে না। গ্যাস সংকট নিয়েই চলছে শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন। সমুদ্রে নতুন এলাকায় গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। স্থলভাগেও নতুন বড় গ্যাসের আধার সম্প্রতি সময়ে পাওয়ার কোন লক্ষণ নেই। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থাানে গ্যাস সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সংকট মোকাবেলায় শিল্প কারখানায় ধীরে চলো নীতিতে গ্যাস দেয়া হচ্ছে। কোনভাবে জোড়াতালি দিয়ে, রেশনিং করে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। এই অবস্থায় নতুন পাইপ লাইনে গ্যাস দেয়া একেবারেই অনিশ্চিত হয়ে আছে। অথচ পাইপ কেনা এবং তা বসানো থেমে নেই।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, খুলনাঞ্চলে একটি চলমান প্রকল্পের আওতায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। আগে থেকেই এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা গ্যাসের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই। গ্যাসের ব্যবহার পুরোপুরি বাণিজ্যিক বিচারে করা উচিত। বর্তমানে সংকট আছে। এই সংকটের মধ্যে আবা নতুন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি স্থলভাগে আরো বেশি অনুসন্ধান করার। ভারত থেকে পাইপ লাইনে গ্যাস আনার আলোচনা চলছে। তরল প্রকৃতিক গ্যাস আমদানিরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসবগুলো বাস্তবায়ন হলে গ্যাস সংকট কাটবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
খুলনা শহরে সঞ্চালন ও বিতরণ গ্যাস পাইপ বসানো শেষ হলেও অকারণেই সে তা পড়ে থাকবে। আগামী কয়েক বছরেও ঐ পাইপে গ্যাস যাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, যদি সেখানে গ্যাস দেয়াও হয় তবে বর্তমান সরবরাহ করা অঞ্চলে ভয়াবহ সংকট তৈরী হবে যা সামলানো সম্ভব হবে না।
পেট্রোবাংলার কোম্পানি সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিসিএল) খুলনায় গ্যাস বিতরণ করবে। নতুন গঠিত এই কোম্পানি খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, ঝিনাইদাহ ও কুষ্টিয়াতে গ্যাস সরবরাহ করবে। তবে এই জেলাগুলোর শুধু সদর এলাকাতেই পাইপ স্থাপন করা হবে। খুলনা শহরে গ্যাস পাইপ বসাতে কিছু সংযোগ পাইপ বা অন্য নাট বল্টু প্রয়োজন হবে। শুধু সেগুলো আমদানি বাকী আছে। এগুলো আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। সেগুলো আনা হলেই পাইপ বসানোর কাজ শুরু হবে।
সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানী লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক এস এম রেজাউল ইসলাম বলেন, খুলনায় বিতরণ লাইন স্থাপনের সকল প্রস্তুতি প্রায় শেষ। প্রয়োজনীয় পাইপ আমদানি করা হয়েছে। আগামী শুষ্ক মৌসুমে পাইপ বসানোর কাজ শুরু হবে। পাইপ লাইনে গ্যাস পেলে যথাসময়ে সরবরাহ করতে পারবো। আমরা তৈরী আছি। তিনি বলেন, যদি যথাসময়ে গ্যাস পাওয়া যায় তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তা সরবরাহ করা হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রথম গ্যাস দেয়া হবে। পরে শিল্পে। পরে অন্যদের। গ্যাসের জন্য খুলনায় ১৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে আছে। ভেড়ামারায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে। পাইপ স্থাপনের অধিকাংশ মালামাল কেনা শেষ হয়েছে। এই পাইপ লাইনে কবে নাগাদ গ্যাস সরবরাহ করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকারের নীতি নির্ধারনী থেকে যে পরিমান গ্যাস দেবে এবং যে গ্রাহকদের অগ্রাধিকার দেবে তাদেরকে সেই পরিমান গ্যাস দেয়া হবে। এবিষয়ে কোম্পানির কিছু করার নেই।
খুলনায় গ্যাস নিতে সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজও প্রায় শেষ হয়েছে। হাটিকামরুল থেকে খুলনা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ২৪৭ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপন কাজ শেষ হয়েছে। শুধু পদ্মা নদীর অংশ টুকু বাকী আছে। হাটিকুমরুল থেকে ভেড়ামারা ৮২ কিলোমিটার এবং ভেড়ামারা থেকে খুলনা ১৬৫ কিলোমিটার। প্রথমে পদ্মা নদীর নিচ দিয়ে এই পাইপ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এখন পদ্মার লালন শাহ সেতুর উপর দিয়ে গ্যাস পাইপ নেয়া হবে। পদ্মা নদীর অংশ টুকু সংযোগ হলেই সঞ্চালন লাইনের কাজ পুরো শেষ হবে। জার্মানীর ড্রীলটেক এই কাজ করবে। ড্রীলটেক এর সাথে নতুন করে চুক্তি করার অনুমোতি চেয়ে গত সপ্তাহে মন্ত্রণলয়ে চিঠি দিয়েছে জিটিসিএল।
সঞ্চালন লাইন প্রকল্প পরিচালক এবং বাংলাদেশ গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির (জিটিসিএল) মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. ইসহাক উদ্দিন বলেন, লালন শাহ সেতু দিয়ে গ্যাস পাইপ নিতে যোগাযোগ মন্ত্রণলয় থেকে অনুমোতি পাওয়া গেছে। এখন মন্ত্রণালয়ের অনুমোতি নিয়ে জিটিসিএল বোর্ডের অনুমোতি পাওয়া গেলেই নতুন চুক্তি করে কাজ শুরু হবে। লালন শাহ ব্রীজের উপর দিয়ে গ্যাস পাইপ স্থাাপন করতে, কাজ শুরুর পর প্রায় এক বছর লাগবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, এই টুকু কাজ শেষ হলেই আমাদের পুরো পাইপ লাইনের কাজ শেষ হবে।
২০০৬ সালে এই সঞ্চালন লাইন স্থাপনের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়।
গ্যাস সংকটের মধ্যেই নতুন পাইপ লাইন স্থাপন বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর বলেন, আমাদের গ্যাসের মজুদ সীমিত। এখন গ্যাসের যে অবকাঠামো আছে শুধু সেই সব এলাকাতেই দীর্ঘকাল গ্যাস সরবরাহ করা কঠিন। সেক্ষেত্রে নতুন সঞ্চালন লাইন নির্মান করা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সংশিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সংকটের এই দেশে নতুন পাইপ লাইন স্থাপন করা আনুমতি সিদ্ধান্ত। আরও খারাপ দিক হচ্ছে মানুষকে আশা দেয়া। খুলনা এলাকার মানুষ স্বপ্ন দেখছে তারা গ্যাস পাবে। চোখের সামনে দেখছে পাইপ বসানো হচ্ছে। ফলে তারা স্বপ্ন দেখতেই পারে। কিন্তু সেই সাধারণ মানুষের স্বপ্ন কবে যে বাস্তব হবে তা কিন্তু অনিশ্চিত।
২০১০ সালে খুলনায় বিতরণ পাইপ বসানোর প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ জেলায় গ্যাস দেয়ার জন্য প্রথমে ২০১০ সালে প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও সরকারের অর্থায়নে এই প্রকল্প হচ্ছে। ২০১৩ সালে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশোধিত যে খরচ ধরা হয়েছে তারমধ্যে ৩০৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এডিবি ঋণ এবং ২৯০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা সরকারি অর্থ।
সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি ভোলাতে ২০ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপন করে গ্যাস দিচ্ছে। এখানে আরো ৫০ কিলোমিটার পাইপ স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভোলায় গ্যাস আছে। সে জন্য সেখানে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে বলে সূত্র জানায়। রাজশাহিতে হাজার কোটি টাকা খরচ করে পাইপ লাইন স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু গ্যাস দেয়া হয়েছে হাতে গোনা কয়েকজনকে। বাকীরা আশা নিয়ে বসে আছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ি খুলনার গ্যাস পাইপ দিয়ে প্রথমে কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস দেয়া হবে। খুলনার ছয়টি, কুষ্টিয়ার একটি, মংলায় একটি এবং ভেড়ামারায় একটি মোট নয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস দেয়ার পরিকল্পনা আছে। যার উৎপাদন ক্ষমতা মোট এক হাজার ২৪০ মেগাওয়াট। এর পর শিল্প কারখানা, সিএনজি স্টেশনে গ্যাস দেয়া হবে। বাসাবাড়িতে সবার পরে দেয়া হতে পারে।
দেশে এখন ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি আছে। চাহিদার বাড়ার সাথে সাথে এ ঘাটতি আরো বাড়বে। গ্যাসের অভাবে বিনিয়োগ হচ্ছে ধীর গতিতে। ভবিষ্যতে গ্যাস ঘাটতি আরো বাড়বে। বর্তমান চাহিদায় গ্যাস সরবরাহ করলে এবং নতুন গ্যাস আবিষ্কার না হলে আগামী ১৫/২০ বছরে দেশের গ্যাস শেষ হয়ে যাবে। বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে এক ট্রিলিয়ন গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে মজুদ আছে ১৫ ট্রিলিয়ন। সংকট মোকাবেলায় তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তা বর্তমান সংকট এলাকায় সরবরাহের জন্য। যদিও এই গ্যাস আমদানির উদ্যোগ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।
ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে জ্বালানি ঘাটতি মেটানোর জন্য বিদ্যুতের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর এ বিদ্যুতের বেশির ভাগ হবে আমদানি করা কয়লা দিয়ে। আমদানি করা কয়লা না হলেও ব্যবহার হবে দেশীয় কয়লা। গ্যাস যেহেতু ফুরিয়ে যাচ্ছে সে জন্য কয়লা হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত মূল জ্বালানি। এই পরিস্তিতিতে গ্যাসের অবকাঠামো নির্মান অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করেই করা উচিত।
এক দশক আগে ধারণা করা হয়েছিল দেশে প্রচুর গ্যাস আছে। সেসময় গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য সরকারি সকল গাড়ি সিএনজিতে রুপান্তরের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সেই অবস্থায় দেশের দক্ষিনাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়। একই সাথে সে সময় গ্যাস রপ্তানিরও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এখন পরিবর্তন হয়েছে। অনুৎপাদনশীল খাতে গ্যাস ব্যাবহার না করার জন্য বিভিন্ন কমিটি বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি সুপারিশ করেছে।