গ্যাস বিক্রিতে লাভ তবু দাম বাড়ানোর উদ্যোগ

গ্যাস খাতে কোন লোকসান নেই। বরং লাভ হচ্ছে। তবু দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ মাসেই বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে পেট্রোবাংলা। আবাসিকসহ সকল গ্রাহকের জন্য দাম বাড়ানোর প্রস্তাব থাকছে। পাইপ লাইনে আবাসিক খাতে গ্যাসের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে দাম দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেয়া হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতিবছর গ্যাস বিক্রি করে মোটা অংকের পরিচালনা মুনাফা করছে পেট্রোবাংলা। সরকারের কোষাগারে জমা দিচ্ছে অর্থ। এই খাতে সরকারের কোন ভর্তুকি নেই। এরআগে ২০১২ সালের ২০ মে পেট্রোবাংলা বিইআরসিতে আবাসিক গ্রাহকদের ছাড়া অন্য খাতগুলোতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু এই খাতে লোকসান নেই বলে বিইআরসি সে সময় দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে সম্মতি দেয়নি। আগের থেকে এখন পেট্রোবাংলার মুনাফা বেড়েছে।
গ্যাস উত্তোলন, পরিবহন ও সরবরাহ এই তিন কাজে যেসব কোম্পানি আছে সকলেই লাভ করছে। বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে যে বেশি দামে গ্যাস কেনা হচ্ছে তাও নিজস্ব তহবিল থেকে শোধ করছে পেট্রোবাংলা। এর বাইরেও ২০০৯ সাল থেকে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে টাকা জমা রাখা হচ্ছে। যে টাকা দিয়ে ইতিমধ্যে একাধিক গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। গ্যাসের বাড়তি দাম দিয়েই ঐ তহবিলে অর্থ জমা রাখা হচ্ছে।
এতসব সকল খরচ করার পরও প্রতিবছর যে অর্থ দিয়ে পেট্রোবাংলা গ্যাস কিনছে তার থেকে বেশি আয় করছে। যদিও দেশীয় কোম্পানির কাছ থেকে কম দামে গ্যাস কেনে পেট্রোবাংলা। বছর ভিত্তিক গ্যাস কেনা ও বেচার পার্থক্য হিসাব করলে দেখা যায় প্রতি বছরই সকল খরচ বাদ দিয়ে গড়ে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৩-১৪ অর্থবছর বিদেশী ও দেশী কোম্পানির কাছ থেকে পেট্রোবাংলা সাত হাজার ৮২৯ কোটি টাকার গ্যাস কিনেছে। ঐ একই বছর গ্যাস বিক্রি করেছে ১১ হাজার ৫৮ কোটি টাকার। অর্থাৎ লাভ হয়েছে তিন হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। এর আগের বছর ২০১২-১৩ অর্থবছরে গ্যাস কিনেছে সাত হাজার ৫৯০ কোটি টাকার আর বিক্রি করেছে ১১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা দিয়ে। লাভ হয়েছে তিন হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে গ্যাস কিনেছে ছয় হাজার ২৪৬ কোটি টাকার, বিক্রি হয়েছে ১১ হাজার ৯৫ কোটি টাকার গ্যাস। লাভ হয়েছে চার হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে গ্যাস কিনেছে পাঁচ হাজার ৫৪ কোটি টাকার। বিক্রি করেছে নয় হাজার ২৩০ কোটি টাকার গ্যাস। লাভ হয়েছে চার হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে পেট্রোবাংলা গ্যাস কিনেছে চার হাজার ৬৩১ কোটি টাকার, বিক্রি করেছে আট হাজার ৮০৫ কোটি টাকার। লাভ করেছে চার হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। বছরে গড়ে প্রায় দুই হাজার ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস কেনা বেচা করে পেট্রোবাংলা। এই লাভের থেকে পরিচালন খরচ বাদ দিয়ে প্রতিবছর গড়ে আড়াই হাজার কোটির টাকার বেশি সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করার অনুমতি পাওয়া গেছে। মন্ত্রনালয় থেকে এই অনুমতি দেয়া হয়েছে। এরআগে প্রধানমন্ত্রী জ্বালানি মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী হিসেবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করার অনুমতি দেন। চলতি মাসের মধ্যেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য বিইআরসিতে আবেদন করা হবে। তারপর বিইআরসি তাদের শুনানীসহ সকল প্রক্রিয়া শেষ করে দাম নির্ধারণ করবে। তিনি বলেন, নতুন করে পর্যালোচনা করে গ্যাসের প্রস্তাবিত দাম নির্ধারণ করা হবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে চেয়ারম্যান বলেন, ২০০৯ সালের পর আর গ্যাসের দাম বাড়েনি। গ্যাস জনগণের সম্পদ। দেশের সকল মানুষের এই সম্পদে অধিকার আছে। অথচ শুধু শহরাঞ্চলে যারা পাইপের মাধ্যমে এই গ্যাস পাচ্ছে তারাই সুবিধা ভোগ করছে। পাইপ লাইন ব্যবহারকারীদের চেয়ে অনেক বেশি দাম দিয়ে গ্যাস ব্যবহার করছে বোতল গ্যাস গ্রাহকরা। তাছাড়া দেশে গ্যাসের সংকট আছে। এই সংকট মেটাতে তরল গ্যাস আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তরল গ্যাস আমদানি করা হলে এর দাম অনেক বেড়ে যাবে।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, পেট্রোবাংলা ২০০৮ সালে লাভজনক ছিল। এই লাভ আরও বেড়েছে। গ্যাস খাত চালাতে সরকারের কোন ভর্তুকি দেয়া লাগে না। এই অবস্থায় তাদের কেন দাম বাড়াতে হবে? তাছাড়া পেট্রোবাংলার হিসাবে স্বচ্ছতা নেই। গ্যাসের উৎপাদন খরচও বাড়েনি। তিনি বলেন, এখনই গ্যাস খাত উন্নয়ন তহবিলে টাকা জমা হচ্ছে। সেখান থেকে টাকা নিয়ে উন্নয়ন কাজ করা সম্ভব। এই অবস্থায় পেট্রোবাংলার আরও কেন টাকা প্রয়োজন? কোন খাতে তারা এই বাড়তি অর্থ খরচ করতে চায় তা পরিষ্কার না। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া যুক্তি সম্মত নয়।
পেট্রোবাংলা সুত্র জানায়, গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য যে প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) জমা দেয়া হবে তা পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। কি পরিমাণ গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে না এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যাচাই বাছাই এরপর নতুন করে দাম নির্ধারন করে কমিশনে প্রস্তাব দেয়া হবে।
আবাসিক গ্রাহকদের সংখ্যা বেশি হলেও ব্যবহারের দিক দিয়ে তা নগন্য। দেশে যে গ্যাস ব্যবহার হয় তার শতকরা প্রায় ১০ ভাগ আবাসিক গ্রাহকরা ব্যবহার করে। বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আবাসিক গ্রাহকরা ব্যবহার করে। যার দাম প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আবাসিকে ব্যবহার হয়েছে ২৫৪ কোটি ১০ লাখ ঘনফুট গ্যাস। যা বর্তমানে সারাদেশে একদিনে ব্যবহার করা গ্যাসের সমান। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট গ্যাস ব্যবহার হয়েছে ২০ হাজার ২৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। একবছরে আবাসিকখাতে গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে গড়ে এক হাজার ৩৭২ কোটি টাকার। বর্তমান থেকে দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলে তা হবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সমান।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগের অনুমতি চেয়ে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় পেট্রোবাংলা। একই সঙ্গে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম কি পরিমাণ বাড়ানো যায় সে বিষয়ে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়। এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরুর অনুমতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে তিনি নতুন করে দাম পর্যালোচনার পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া প্রস্তাবনা অনুযায়ি, আবাসিক খাতে এক চুলার গ্যাসের দাম ৪০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা এবং দুই চুলা ৪৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এক চুলায় ১১২ দশমিক ৫০ এবং দুই চুলায় ১২২ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল। আবাসিকে মিটার ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে প্রতি হাজার ঘনফুট ১৪৬ টাকা ২৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৩৫ টাকা বা ৬০ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল।
এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জন্য ৭৯ টাকা ৮২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮৪ টাকা (৫.২৪ শতাংশ), বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ২৬৮ টাকা ০৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩৫০ টাকা (৩০ দশমিক ৫৫ শতাংশ), শিল্প গ্রাহকদের ১৬৫ টাকা ৯১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২২০ টাকা (৩২ দশমিক ৬০ শতাংশ), চা বাগানে ১৬৫ টাকা ৯১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা (২০ দশমিক ৫৫ শতাংশ), ক্যাপটিভে ১১৮ টাকা ২৬ পয়সা বাড়িয়ে ২৪০ টাকা (১০২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ) এবং সার কারখানায় ৭২ টাকা ৯২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা (৯ দশমিক ৭১ শতাংশ) করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সিএনজিতে প্রতি হাজার ঘনফুটে ৮৪৯ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ১৩২ টাকা ৬৭ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।
২০০৯ সালের ১লা আগস্ট গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল। এরপর আর বাড়ানো হয়নি। এরমধ্যে কয়েকদফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দামও।