গ্যাস সংকটে ৩০ শতাংশ শিল্প উৎপাদন কমার আশঙ্কা
তামান্না আক্তার:
নিত্যবছরের সাথে এবার যোগ হয়েছে সরবরাহ সমস্যা। তাই অন্য যে কোন শীতের চেয়ে এবার গ্যাস সংকট বেশি। এমনি শীতে চাহিদা বেশি থাকে। তাতে উৎপাদন আর আমদানি দুটোই কম। একদিকে চাহিদা বেশি অন্যদিকে সরবরাহ কম। সবমিলে গ্যাস সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
দিনে বেশিরভাগ সময় গ্যাস থাকছে না। রাতে গ্যাসের চাপ কিছুটা বেশি। আবাসিক, সিএনজি, বাণিজ্যিক, শিল্প সব গ্রাহকের একই অবস্থা।
রাজশাধীর আশপাশে শিল্প এলাকা যেমন, সাভার, গাজীপুর, কোনাবাড়ি, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জসহ, চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সংকটটা বেশি। এসব এলাকার শিল্পমালিকরা কর্মঘণ্টার বেশিরভাগ অলস কাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তাদের কারখানা দিনের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকছে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও প্রায় একমাস লেগে যাবে।
দ্রুত সংকট মেটাতে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর দাবি করেছেন উদ্যোক্তারা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সমুদ্রের ভাসমান টার্মিনালের সমস্যা মিটে গেলে সংকটও কেটে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকট হবে এটা অনেক আগে থেকেই সবার জানা। তবুও সে অনুযায়ি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
কয়েকদিন ছোট বড় ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ আছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে ২২৫ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস প্রয়োজন হয় সেখানে সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ৭২ কোটি ঘনফুট। শীত হওয়াতে বিদ্যুতের চাহিদা কম। এজন্য বিদ্যুতের ঘাটতি খুব বেশি হচ্ছে না। সার উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে অর্ধেকের বেশি। ৩১ কোটি ৬০ লাখ ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে দেয়া হচ্ছে ১৪ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট।
পেট্রোবাংলার দেয়া তথ্য অনুযায়ি ১৯শে জানুয়ারি দেশীয়, দেশে বিদেশী কোম্পানি এবং এলএনজি আমদানি করে মোট ৩৭৬ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করার ক্ষমতা ছিল। আর গ্যাস সরবরাহ হয়েছে ২৫২ কোটি ১৫ লাখ ঘনফুট। ক্ষমতার গড়ে ৭০ শতাংশ সরবরাহ করা গেছে। বাকীটা ঘাটতি।
দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ক্ষমতা ১১৪ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট। সরবরাহ হয়েছে ৮৬ কোটি ৯৪ লাখ ঘনফুট। দেশে বিদেশী কোম্পানির (আইওসি) ক্ষমতা ১৬১ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট, সরবরাহ করেছে ১৪৩ কোটি ৬৩ লাখ ঘনফুট। এলএনজি আমদানির ক্ষমতা ১০০ কোটি ঘনফুট, আনা গেছে ৪০ কোটি।
রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিদেশী কোম্পানি শেভরণের উৎপাদন কম। গ্যাস উৎপাদন আরও বাড়ানোর জন্য এই রক্ষণাবেক্ষণ চলছে বলে শেভরণের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। শেভরণ পরিচালিত জালালাবাদ ক্ষেত্রের ক্ষমতা ২৭ কোটি ঘনফুট, হচ্ছে ২০ কোটি ৮০ লাখ। মৌলভীবাজারে ক্ষমতা চার কোটি ২০ লাখ, হচ্ছে এক কোটি ৮০ লাখ। বিবিয়ানায় ক্ষমতা ১২০ কোটি, হচ্ছে ১১৬ কোটি ৭৮ লাখ ঘনফুট। এছাড়া তাল্লোর বাঙ্গুরায় ১০ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট ক্ষমতার মধ্যে হচ্ছে চার কোটি ২০ লাখ ঘনফুট।
গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় শিল্প উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। গ্যাস সংকটের কারণে গত
বিটিএমএ এর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এনার্জি বাংলাকে জানিয়েছেন, গ্যাসের কারণে শিল্প উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। এভাবে চললে করোনার পর ঘুরে দাঁড়াতে থাকা অর্থনীতি আবার বাধাগ্রস্ত হবে। যে গ্যাস সংকট তাতে শিল্প উৎপাদন ৩০ শতাংশ কম হবে। অর্থনীতিতে বিরূপ চাপ পড়বে।
অধ্যাপক ড. ম তামিম এনার্জি বাংলাকে বলেন, যথাযথ উদ্যোগ না নেয়ার কারণে আজ সংকট বেশি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেশি। যদি কমে যায় তবুও আমরা বেশি আমদানি করতে পারবো না। কারণ সেই অবকাঠামো নেই। আর দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান করা হয়নি।
বিজিএমইএ এর সভাপতি ফারুক হাসান এনার্জি বাংলাকে বলেন, গ্যাসের কারণে ক্রয়াদেশ নিয়েও তা ঠিকমত দেয়া যাচ্ছেনা। কারণ কারখানা পুরো সময় ধরে চলতে পারছে না।
১৮ই নভেম্বর সামিটের এলএনজি টার্মিনালের মুরিং ছিঁড়ে যায়। এতে টার্মিনালটিতে কোনো এলএনজিবাহী কার্গো ভিড়তে পারছে না। এতে দৈনিক প্রায় ৪০-৪৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী মাসের ১০ থেকে ১৫ তারিখের আগে এটি মেরামত হবে না। অন্যদিকে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে কূপ সংস্কারের কাজ চলছে বলে শেভরণ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, কারিগরি কারণে গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করছে। দেশে দেড় যুগের বেশি সময় কমবেশি গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। উৎপাদন-বিনিয়োগ যে হারে বেড়েছে, সেই হারে স্থানীয় উৎপাদন বা অন্য দেশ থেকে আমদানি হয়নি। দেশে গ্যাসের প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মজুদ কমে এখন প্রায় ১০ টিসিএফে ঠেকেছে। এলএনজি আমদানি শুরুর পর পরিস্থিতি উন্নতি হবে মনে করা হলেও তা হয়নি। গত দুই-তিন বছর চাহিদার চেয়ে জোগানের ঘাটতি ৮০-১০০ কোটি ঘনফুট। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় গত জুন মাস থেকে এলএনজি আমদানি কম হচ্ছে। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদনও কমেছে। এর মধ্যে সামিটের টার্মিনালের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ এবং বিবিয়ানায় কূপ সংস্কারের কারণে দৈনিক ৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় সংকট প্রকট হয়েছে।