গ্যাস সংকট: কেউ রাঁধেন গভীর রাতে, কেউ কিনেছেন বিদ্যুতের চুলা
নিজস্ব প্রতিবেদক/ বিডিনিউজ:
ঢাকায় দিন শুরুর আগেই বহু বাসা বাড়িতে চুলার গ্যাস উধাও হয়ে যায়; মধ্যরাতে কিছু কিছু বাসায় যখন একটু একটু করে গ্যাস আসে, তখন বাসিন্দাদের ঘুমাতে যাওয়ার সময়।
এই পরিস্থিতিতে রান্নার কাজ কীভাবে সামাল দিচ্ছেন গৃহিণীরা? পরিবারের সদস্যদের ক্ষুধা নিবারণই বা কীভাবে হচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মিলেছে ভোগান্তির নানা খবর। কেউ রান্না করেন গভীর রাতে, তীব্র শীতে কেউ বিছানা ছাড়েন ভোরের আগে, কেউ কিনেছেন বিদ্যুতের চুলা, কারো বাসায় কেনা হয়েছে এলপিজি সিলিন্ডার, কেরোসিনের চুলা, কেউ বা হোটেলের খাবারে ক্ষুধা নিবারণ করছেন।
ঘুমের সমস্যায় স্বাভাবিক জীবনাচরণে ঘটছে ব্যাঘাত, খাবার সংকটে স্বাস্থ্য নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা, সবচেয়ে বড় কথা, গ্যাস না পেলেও মেটাতে হচ্ছে বিল।
প্রতি বছর শীতকালে ঢাকার আংশিক এলাকায় গ্যাসের ভোগান্তি হলেও এবার গ্যাস না থাকার সময়টি আগের তুলনায় দীর্ঘ হচ্ছে, নতুন নতুন এলাকার নামও যুক্ত হয়েছে এবার।
গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা তিতাস গ্যাসের মহাব্যবস্থাপক দাবি করেছেন, কয়েকদিন আগের তুলনায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
তিনি এমনও বলেছেন, গ্যাস একেবারে নেই এমন না, কোথাও দিনে থাকে না কোথায় থাক না রাতে। আপাতত এভাবেই চলতে হবে।
ঘাটতি কত
গত নভেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগে গ্যাসের স্বল্পতা দেখা দেয়। মাঝে কয়েকদিন সংকটের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তা বিদ্যুৎ উৎপাদনকেও ব্যাহত করেছিল। শীতে কম চাহিদার বাজারেও দৈনিক ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়েছে।
দৈনিক চাহিদা প্রায় ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে সরকারি গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি এতদিন ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিতে পারছিল। তবে গত ২৫ জানুয়ারি জাতীয় গ্রিডে দৈনিক গ্যাস দেওয়া গেছে ২৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সাগরে ভাসমান একটি এলএনজি টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণ কাজে সরবরাহ বন্ধ রাখায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
আগামী মার্চ পর্যন্ত এই পরিস্থিতি বিরাজ করবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ঢাকায় গ্যাস সরবরাহকারী তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির আওতাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা, শিল্প ও আবাসিক সংযোগের জন্য দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ছিল ২৪৩০ মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ করা গেছে ১৬২৮ মিলিয়ন।
সার কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের ঘাটতি দেখালেও শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্র ঘাটতি কতটা তা প্রকাশ করেনি পেট্রোবাংলা।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকায় বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংকট অনেকটাই কমে গেছে। কিছু এলাকায় লাইনে ছিদ্র কিংবা পুরোনো লাইনসহ বিভিন্ন কারণে গ্যাসের চাপ কম থাকছে। গ্যাসের সমস্যা দেশের সামগ্রিক একটা সমস্যা। জাতীয় সরবরাহ না বাড়লে তিতাসের পক্ষ থেকে আর বাড়তি কিছুই করার নেই।”
বিকল্প উপকরণ বাড়িয়েছে খরচ
মিরপুর ১০, ১১, ১২, কালশী ও পল্লবী, মহাখালী, ওয়্যারলেস ও টিবি গেইট এলাকায় মাসখানেক ধরে গ্যাসের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
গ্যাস না থাকায় বিকল্প হিসেবে এলপিজি সিলিন্ডার, ইলেকট্রিকের চুলা যেমন- ইনডাকশন কুকার, ইনভার্টার চুলা, রাইস কুকার ও ওভেনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
মহাখালীর টিবি গেইট এলাকার সরকারি চাকরিজীবী জয়ন্তী রানী দাস বৈদ্যুতিক ইনভার্টার চুলা ব্যবহার করছেন। কিন্তু তাতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, “সবার তো এই খরচটা করার সুযোগ নাই। তাদের তো অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরাও অনেকদিন কষ্ট করেছি।
“ইনভার্টারে মূল সমস্যা রান্না করতে সময় লাগে। আর চুলার মত রান্না আসলে হয় না। এখানে কোনো রকম চালানো আরকি।”
গ্যাস কখন আসে কখন যায়, এ নিয়ে গোলকধাঁধায় জয়ন্তী। তিনি বলেন, “কোনোদিন রাত ১টায় আসে। তখন তো ঘুমানোর সময়।”
মিরপুর ১২ নম্বরের ডি ব্লকের বাসিন্দা সাহানা কাদের ইনডাকশন চুলা কিনতে বাধ্য হয়ে ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, “গ্যাসের বিল দিচ্ছি, আবার ইলেকট্রিকে রান্না করছি। খরচ না করেও তো উপায় নেই। দুই চুলায় রান্না করা যায় দ্রুত। কিন্তু ইনডাকশন কুকারে একটা একটা করে তরকারি রান্না হয়। অনেক সময় চাইলেও একটা খাবার রান্নার সুযোগ বা সময় কোনোটাই থাকে না।”
ইনডাকশন কুকারের জন্য আলাদা ফ্রাইপ্যান ও হাঁড়ি কিনতে হয়েছে তাকে। এই এককালীন খরচটা বেশ চাপ তৈরি করেছে তার ওপর।
মিরপুর ১২ নম্বরের ই-ব্লকের বাসিন্দা নাহিদা পারভীন এলপিজি সিলিন্ডার কিনেছেন।
তিনি বলেন, “একদিকে লাইনের গ্যাসের দুই চুলা, আরেক পাশে সিলিন্ডারের জন্য একটি চুলা। কী করব? আমাদের তো চলতে হবে। না খেয়ে কষ্ট করে কতদিন চলা যায়?”
কালশীর বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম পেশায় রাজমিস্ত্রি। আয় খুব বেশি এমন নয়। এলপিজি সিলিন্ডার বা বৈদ্যুতিক চুলা কেনার সামর্থ্য নেই। তাই কেরোসিনের স্টোভ কিনেছেন।
“সিলিন্ডারের খরচ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আবার কারেন্টের চুলা কেনার সামর্থ্যও নাই। তাই স্টোভ কিনছি। কিন্তু এতে তো আবার কেরোসিনের খরচ হয় বেশি। রাত দেড়টা থেকে ২টায় যখন গ্যাস আসে, তখন আমার বউ রান্না করে। যখন বেশি দরকার হয়, তখন স্টোভ চালাই।
“কিন্তু ছোট বাচ্চাকে সব সময় গরম খাবার খাওয়াতে পারি না। আমরাও এই শীতের মধ্যে ঠান্ডা খাবার খাই।”
হোটেলের খাবারে ভরসা, স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা
পূর্ব রাজাবাজার এলাকার শাহীনা আক্তার গত দুই মাস ধরে সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত লাইনের গ্যাস পাচ্ছেন না। গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে তাদের আট সদস্যের পরিবারে ভীতি কাজ করে। ভোরে উঠে রান্না করতে না পারলে হোটেল থেকে খাবার এনে খেতে হয় পরিবারের সদস্যদের।
লালবাগের বাসিন্দা হাজী বাবলু মিয়া বলেন, “লালবাগে অনেক এলাকায় সকাল থেকে চুলায় গ্যাস নেই বললেই চলে। কীভাবে চলছে তা বোঝাতে পারব না।
“ছোট ঘর সিলিন্ডার রাখাও সাহস পাচ্ছি না আর লাইনের গ্যাসও পাচ্ছি না, হোটেলের খাবার খেতে খেতে শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ।”
পুরান ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, “প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৪টায় ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে রান্না বসাই। ছয়টার সময় গ্যাস চলে যায়। তার আগেই রান্না শেষ করি।
“প্রচণ্ড শীতে সকালে উঠতে মন চায় না। তখন দিনের বেলা বাইরে থেকে কিনে খেতে হয়।”
মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের সালেহা বেগম রাইস কুকার এবং ওভেনে কিছুটা কাজ চালাচ্ছেন।
“নিজেরা কোনোরকম কাজ চালিয়ে নেই। কিন্তু কয়েকদিন আগে বাসায় মেহমান এসেছিল। তখন খুব লজ্জায় পড়তে হল। ওভেনে বা রাইস কুকারে তো চা বানানোর উপায় নাই। রান্না করে খাওয়ানোরও সুযোগ নাই। গ্যাস না থাকায় পানিও গরম করা যাচ্ছে না। এই শীতে খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমাদের। ইলেকট্রিকের চুলা কিনে ফেলব ভাবছি,” বলেন তিনি।
রেবেকা এক বাসার খাবার রান্না করেন আরেক বাসায়
১১ বছর সদরঘাট এলাকার আশেপাশে বিভিন্ন ছাত্রাবাসে রান্নাবান্না করেন কুড়িগ্রামের রেবেকা আক্তার। পাঁচটি বাসায় প্রতিদিন রান্না করতে হয় তাকে।
এখন তার সময়ের হিসাব মেলে না। কেবলই দেরি হয়ে যায়।
তিনি বলেন, “এত বছর ঢাকা শহরে আছি, গ্যাসের এমন সমস্যা দেখিনি।”
তিনি যেসব বাসায় কাজ করেন, তার দুটিতে গ্যাস একদম থাকে না। দুটিতে দুপুরবেলায় থাকে, বাকি একটিতে তেমন সমস্যা নাই।
যে দুই বাসায় গ্যাস থাকে না, তাদের রান্না অন্য বাসা থেকে করে দিতে হচ্ছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী পুরান ঢাকার কলতাবাজার ও লক্ষ্মীবাজার এলাকায় থাকেন। তাদের অনেকেই আলাদা রান্না করে খান। গ্যাস সংকটের কারণে এখন তা কঠিন হয়ে পড়েছে।
মাকসুদা আক্তার পিংকি বলেন, “আমরা ছয়জন থাকি। একজনের পর আরেকজন রান্নার সিরিয়ালে থাকতে হয়। আগে যেখানে একেকজনের রান্না করতে গড়ে ৪০ মিনিট লাগত, এখন দুই ঘণ্টায়ও রান্না শেষ হয় না। অনেক সময় তরকারি পুরোপুরি সেদ্ধই করতে পারি না।”
আজিমপুরে শাহনাজের ‘এবারই প্রথম’
স্বামী আর এক সন্তানকে নিয়ে সাত বছর ধরে আজিমপুর শেখ সাহেব বাজার রোডের একটি বাসায় থাকেন শাহনাজ পারভিন। এবারই এ এলাকায় গ্যাসের সমস্যা প্রথমবার দেখেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভোর থেকে চুলায় যতটুকু গ্যাস থাকে, তা নিয়ে দুই ঘণ্টায় এক পাতিল পানিও গরম হয় না।
“বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে একটু চাপ বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। এভাবেই রান্নাসহ নানা কাজ সারিয়ে নিয়ে হয়।“
এভাবে কতদিন চলবে সে প্রশ্ন রেখে শাহনাজ বলেন, “আমার ছোট সংসার, তাও এত কষ্ট। পরিচিত অনেক পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক। তারা তো আরো অনেক কষ্টে আছেন।”
রাতে তো পাচ্ছে: তিতাস গ্যাস এমডি
রাজধানীতে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংকটের এই সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সার কারখানাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা গ্যাস সরবরাহ করছি। তারপর আবাসিকে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। গ্যাসের যেমন সরবরাহ আছে সেভাবেই আমরা দিচ্ছি।
“আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পে দৈনিক ১৬০০ থেকে ১৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। সেখানে ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে।”
তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেছেন, গ্যাস সংকট সমাধানে কোনো ‘ম্যাজিক’ নেই
সংকট কিছুটা কমার দাবি করে তিনি বলেন, “কোনো কোনো এলাকায় হয়ত দিনে পায় না, রাতে পায়। একেবারেই পায় না- এমনটি নয়। মধ্যরাতে যারা গ্যাস পান, সেক্ষেত্রে কিছু করার নেই। এটা কোনো ম্যাজিক নয় যে, বাড়িয়ে দেব। এখানে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না।”
‘তারা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করুক’
গ্যাস না পেয়েও বিল দেওয়ার বিষয়ে গ্রাহকরা যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, সেই প্রশ্নে তিতাসের এমডি বলেন, “দিনে রাতে যেভাবে গ্যাস পাচ্ছে, গ্রাহক কিন্তু প্রয়োজন মেটাচ্ছে। একেবারেই গ্যাস পাচ্ছে না এমন হচ্ছে না। যারা বলে যে, গ্যাস পাই না বিল দেব কেন, তাদের বিষয়ে কথা হচ্ছে, তারা গ্যাসলাইন বিচ্ছিন্ন করে দিক। সেই স্বাধীনতা তাদের আছে, এই ক্ষেত্রে এলপিজি ব্যবহার করুক।”