ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাত: ২৩জনের মৃত্যু
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে ২৩জনের মৃত্যু হয়েছে। ঝড়ের প্রবল বাতাসে গাছ ও বাড়ি ভেঙে এই মৃত্যু হয়। উপকূল অতিক্রম করার পর বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হয়েছে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু।
গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যের সখ্যা এটি।
এরআগে প্রায় একই শক্তির দুই ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’ ও ‘মহাসেন’ এ এত মানুষ মারা যায়নি।
চট্টগ্রাম, ভোলা ও পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, চাঁদপুর, ঝালকাঠি, বরিশালসহ উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঝড়ে শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার পাশাপাশি ঘরবাড়ি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
ঝড়ো হাওয়ার দাপট শুরু হয়েছিল শনিবার ভোর রাত থেকেই; সেই সঙ্গে বৃষ্টি। বেলা দেড়টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রামের কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। এরপর ঝড়ের দাপট চলে আরও কয়েক ঘণ্টা।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চট্টগ্রামে মা-ছেলেসহ ১১ জন, নোয়াখালীর হাতিয়ায় জোয়ারে ভেসে মা-মেয়েসহ তিনজন ও ফেনীর সোনাগাজীতে এক রাখাল, কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় চাপা পড়ে ও নৌকার ধাক্কায় তিনজন, ভোলার তজমুদ্দিন ও দৌলতখানে ঘরচাপা পড়ে তিনজন, পটুয়াখালীর দশমিনায় এক বৃদ্ধা এবং লক্ষ্মীপুর সদরে গাছ উপড়ে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
গত বছরের জুলাইয়ে প্রায় একই শক্তির ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’ এর আঘাতে কক্সবাজার, পটুয়াখালী, ভোলা ও নোয়াখালীতে চার জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
আর ২০১৩ সালের মে মাসে আঘাত হানা একই মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ এ প্রাণ যায় ১২ জনের। এর মধ্যে বরগুনায় পাঁচজন, পটুয়াখালীতে তিন ও ভোলায় চারজন নিহত বলে জানা যায়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবর:
চট্টগ্রাম
ঘূর্ণিঝড়ের সময় নগরীর ষোলশহরে এক পথশিশু, হালিশহরে এক চিংড়ি ঘেড় কর্মচারী ও সীতাকুণ্ডে মা-ছেলের মৃত্যু হয়; আর রোয়ানু’র ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বাঁশখালী উপজেলার দুটি ইউনিয়নে অন্তত সাতজনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
শনিবার সন্ধ্যার পর জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের কাছে মৃতের সংখ্যার এই পরিসংখ্যান দেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পাঁচলাইশের ষোলশহরে চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্সের কাছে একটি বাসার ছাদ থেকে আসা ইঁটের আঘাতে রাকিব (১১) নামে ওই পথশিশু গুরুতর আহত হয়।
তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কতর্ব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান সংশ্লিষ্ট পুলিশ ফাঁড়ির নায়েক জাহাঙ্গীর আলম।
আর হালিশহরের একটি চিংড়ি ঘেরে কাজ করার সময় দুই ভাই জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়, বিকালে এদের একজনের লাশ পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিকভাবে তার নাম পরিচয় জানা যায়নি।
এর আগে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল ছলিমপুরের পাহাড়ি এলাকা কালাপানিয়া লোকমানের ঘোনা এলাকায় ঘরের উপর গাছ ভেঙে পড়লে এতে চাপা পড়ে মা-ছেলের মৃত্যু হয় বলে জানান ইউএনও নাজমুল ইসলাম ভুঁইয়া।
নিহতরা হলেন- স্থানীয় মোহাম্মদ রফিকের স্ত্রী কাজল বেগম (৪৮) ও তার ছেলে বেলাল হোসেন বাবু (১০)।
স্থানীয়রা জানান, পাকা খুঁটি ও বেড়া দিয়ে তৈরি ঘরে থাকতো থাকতেন কাজল বেগম। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ঝড়ো হাওয়ায় একটি গাছ ভেঙে ওই ঘরের ওপর পড়ে।
আর বাঁশখালীতে সাতজন নিহত হয়েছেন খানখানাবাদ ও ছনুয়া ইউনিয়নে।
এদের মধ্যে ছনুয়ায় নিহত এক নারীর নাম তাহেরা বেগম, তার স্বামী মো. হারুন। বাকিদের নাম জানা যায়নি।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মেজবাহ বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় দুপুরে জলোচ্ছ্বাসের পানি বেড়িবাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়ে। এতে পানিতে ডুবে সাতজনের নিহত হওয়ার খবর জেনেছি।
“বিভিন্ন ইউনিয়নে আরও পাঁচ জন নিখোঁজ আছে বলে স্থানীয়দের মাধ্যমে শুনেছি। এ বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি।”
বাঁশখালী থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানান, বাঁশখালী উপজেলার খানখানাবাদ, গণ্ডামারা, শেখের খিল ও ছনুয়ায় জলোচ্ছ্বাসের কারণে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিতে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে।
নোয়াখালী
হাতিয়ায় মা-মেয়েসহ তিন জনের মৃত্যু হয়েছে শনিবার সকালে, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু থেকে বাঁচতে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে জোয়ারে ভেসে।
নিহতরা হলেন- বয়ার চরের আলির ঘাট এলাকার আবুল কাশেমের স্ত্রী মিনারা বেগম (৩৫), তাদের মেয়ে রুমা (১০) ও জাহাজমারা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে সালাউদ্দিনের স্ত্রী মাকসুদা বেগম (৫১)।
বয়ারচর ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক মুসফিকুর রহমান জানান, সকালে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় জোয়ারে ভেসে যায় মিনারা ও তার মেয়ে রুমা। বেলা ২টার দিকে তাদের লাশ পাওয়া যায়।
মাকসুদা বেগমও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে জোয়ারে ভেসে যান বলে জানান জাহাজমারা ইউপির চেয়ারম্যান মাসুম বিল্লাহ।
ভোলা
বাংলদেশ রেড ক্রিসেন্টের সাইক্লোন প্রিপার্ডনেস প্রোগ্রামের উপ পরিচালক মো. শাহাবুদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, শুক্রবার শেষরাতের দিকে ভোলায় প্রবল ঝড়ো হাওয়া শুরু হলে তজুমদ্দিনে ঘর ও গাছ চাপা পড়ে দুজনের মৃত্যু হয়।
এরা হলেন- চাঁদপুর ইউনিয়নের শশিগঞ্জ গ্রামের নয়নের স্ত্রী রেখা বেগম (৩৫) ও মফিজের ছেলে আকরাম (১৪)।
শাহাবুদ্দবীন বলেন, ভোর ৪টার দিকে ঝড়ের তীব্রতা বেড়ে গেলে ঘরচাপা পড়ে আকরাম আহত হন। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল ৬টায় তার মৃত্যু হয়। আর গাছ ভেঙে ঘরের ওপর পড়লে মারা যান রেখা বেগম।
আর বিকাল ৩টার দিকে দৌলতখান উপজেলায় ঘর চাপা পড়ে এক নারীর মৃত্যু হয় বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কর্মকর্তা কহিনুর বেগম।
নিহত রানু বিবি (৫০) উপজেলার দক্ষিণ জয়নগর ইউনিয়নের ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী।
কক্সবাজার
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে কক্সবাজারে কুতুবদিয়া উপজেলায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ১০ জন।
নিহতরা হলেন, উপজেলার উত্তর ধুরুং এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে মো. ইকবাল (২৫), উত্তর কৈয়ার বিল এলাকার ফয়েজুর রহমানের ছেলে ফজলুল হক (৫৫) এবং আলী আকবর ইউনিয়নের মুস্তাফিজুর রহমানের ছেলে শফিউল আলম (৩৬)।
জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, ইকবাল দেয়াল চাপায় এবং ফজলুল নৌকার ধাক্কায় নিহত হয়েছেন।
আর মুস্তাফিজ জলোচ্ছ্বাসে মাটির ঘর ভেঙে গিয়ে চাপা পড়ে মারা যান বলে জানান কুতুবদিয়া থানার ওসি অং সা তুয়াই।
আহতদের দুই জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পাঁচ জনকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। বাকি তিন জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক জানান।
ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া ও টেকনাফ উপজেলার সাড়ে ২৮ কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ কোথাও আংশিক ও কোথাও সর্ম্পূণ ধসে গেছে। এছাড়া শতাধিক বসত ঘর ক্ষতিগ্রস্ত এবং জেলার বেশ কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
পটুয়াখালী
দশমিনার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজহারুল ইসলাম জানান, সকালে প্রবল ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে ঘর ভেঙে পড়লে পটুয়াখালী দশমিনা উপজেলার সদর ইউনিয়ন লক্ষ্মীপুর গ্রামে নয়া বিবির (৫২) মৃত্যু হয়।
ঝড়ে ওই এলাকার ১০-১২টি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে বলে তিনি জানান।
লক্ষ্মীপুর
ঝড়ো হাওয়ায় গাছ উপড়ে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও একজন।
উপজেলার উত্তর তোওয়ারিগঞ্জ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাজ্জাদুর হাসান জানান।
নিহত আনোয়ার উল্লাহ (৫৫) ওই এলাকার বশির উল্লাহর ছেলে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারকে ২০ হাজার ও আহতের পরিবারকে ৫ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হবে বলে জানান সাজ্জাদুর হাসান।
ফেনী
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু দুপুরে ফেনীর সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানলে সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়ার জেলে পাড়া এলাকায় জোয়ারের পানিতে ভেসে এক রাখালের মৃত্যু হয়েছে।
নিহত নুর আলম (৩৪) এ বাড়ি চরচান্দিয়ার জেলে পাড়া এলাকায় বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন সোনাগাজীর ইউএনও শরীফা হক।
এছাড়া রোয়ানুর প্রভাবে সোনাগাজীর তিনটি ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রামের ঘরবাড়ি জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।