চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে সাড়ে ২৯ লাখ টন কার্বন নিঃসরণ
চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে প্রায় ২৯ লাখ ৫০ হাজার টন কার্বন নির্গত হয়।
বায়ুর মান নিয়ে প্রথমবারের মতো চালানো গবেষণায় বায়ুদূষণের ভয়াবহ মাত্রার বিষয়টি জানা গেছে। বন্দর প্রতিষ্ঠার ১৩০ বছর পর এই গবেষণা পরিচালিত হলো। পণ্য খালাস করতে বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় আসা ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরিসহ প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার গাড়ির প্রবেশ, সনাতন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ডেলিভারি পদ্ধতি, দীর্ঘক্ষণ মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ ও গাড়ির অবস্থান ও ডিজেলচালিত যন্ত্রপাতির অধিক ব্যবহার দূষণ বাড়াচ্ছে।
ছয় মাস ধরে চালানো গবেষণায় দেখা যায়, মোট কার্বন নিঃসরণ হয়েছে ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৫১২ দশমিক ৩৪ টন। প্রতিদিন সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করা গাড়ির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়াচ্ছে ট্রাক। ছয় মাসে শুধু ট্রাক থেকেই কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ টন। কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়াও নাইট্রোজেন অক্সাইড, পার্টিকুলার ম্যাটেরিয়াল (ধূলিকণা), সালফার ডাইঅক্সাইড, ব্ল্যাক কার্বন এবং কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাসও দূষণ ছড়াচ্ছে বন্দরে। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন এখানে কাজ করা সহস্রাধিক শ্রমিক-কর্মচারীও।
গবেষণার নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল আমীন। তার সঙ্গে ছিলেন বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আকলিমা আক্তার ও আবির দে । ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দর এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে নমুনা নিয়ে এ গবেষণা পরিচালনা করেন তারা। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা এতে সহায়তা করে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে গবেষণা প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে।
গবেষণার প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ আল আমীন বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বায়ুদূষণ নিয়ে এ ধরনের গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় পাঁচটি গ্যাসের আধিক্য পাওয়া গেছে। দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছে সমুদ্রগামী জাহাজ ও ট্রাক। এসব জাহাজ ও ট্রাকের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ডিজেল। যা থেকে বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হচ্ছে। এর পাশাপাশি ডিজেলচালিত যন্ত্রপাতি থেকেও বায়ু দূষিত হচ্ছে। দূষণ কমানোর জন্য সবুজ বন্দর, বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং জেটিতে নোঙর করা জাহাজগুলোতে জেনারেটরের পরিবর্তে বিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন তিনি।
গবেষণায় দেখা যায়, দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী যানবাহন এবং বড় বড় জাহাজ। ছয় মাসে নিঃসরণ হওয়া ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৫১২ দশমিক ৩৪ টন কার্বনের মধ্যে ব্ল্যাক কার্বন ৪৬ দশমিক ৮২ টন, সালফার ডাইঅক্সাইড দুই হাজার ৩৯২ দশমিক ৫৯ টন, কার্বন মনোঅক্সাইড ৬১৬ দশমিক ১৪ টন এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড দুই হাজার ৯৫১ দশমিক ৬৭ টন। এ ছাড়া আছে পার্টিকুলার ম্যাটেরিয়াল (ধূলিকণা)। শুধু সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয় এক লাখ ২৮ হাজার ৫৭১ দশমিক ৫৫ টন এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গত হয় এক হাজার ৩৬৬ দশমিক ৬৪ টন, ট্রাক থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয় ১২ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭২ টন এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড ৮৯৪ দশমিক ৩৮ টন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, বন্দরে জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন কয়েক হাজার ট্রাকও প্রবেশ করে। ডিজেলচালিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থেকেও নির্গত হচ্ছে ধোঁয়া। এ ধরনের গবেষণা বন্দরের জন্য উপকারী।
গবেষণার সমন্বয়ক এবং জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থার প্রতিনিধি ডেভিড রুবাইয়া বলেন, জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থার অধীনে চট্টগ্রামসহ পাঁচটি দেশের বন্দরে এ ধরনের গবেষণা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বন্দরগুলো দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। তবে কোনো গ্যাসের মানমাত্রা কত তা জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থা থেকে এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। তিনি জানান, জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাতাসে ধূলিকণার (পার্টিকুলার ম্যাটার) মানমাত্রা হচ্ছে ২৫ কিউবিক মিটার। এর বেশি হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম বলেন, বেশি দূষণ করে ২৫ থেকে ৩০ বছরের পুরনো জাহাজ। এসব জাহাজ ঢুকতে দেয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা হবে। তাছাড়া নিয়মিত বায়ুর মান পরীক্ষার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ স্বতন্ত্র মনিটরিং সেল গঠন করবে।
সুপারিশে বলা হয়, জাহাজের গড় অবস্থান সময় কমানো, পুরাতন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ট্রাকের ব্যবহার কমানো, জেটিতে ভেড়ানো জাহাজগুলোর জেনারেটরের পরিবর্তে বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা, যন্ত্রপাতিতে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো, অভ্যন্তরীণ পরিবহনে হাইড্রোলিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ানো, বন্দরের সব প্রবেশপথে অটোমেশন আরও দ্রুত করা, ইয়ার্ডে বনায়ন, বন্দরে সনাতন পদ্ধতিতে পণ্য খালাশ কমানো দরকার।