চুক্তি হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয় না
স্থায়ী বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অনেক চুক্তি হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়েছে অনেক কম। উৎপাদনে আসাতো দহৃরে থাক বিন্দুমাত্র কাজই করতে পারেনি অনেকে। একাধিক কোম্পানি কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারের সাথে চুক্তি করেছে। নিদিষ্ট সময়ে এসব কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। সেই ভরসায় সরকারও তার পরিকল্পনা সাজিয়েছে। কিন্তু চুক্তির কাজ আলোর মুখ দেখেনি। তাদের কাজের অগ্রগতি শুন্য।
এদিকে যারা বিন্দুমাত্র কাজ করতে পারেনি এমন কিছু চুক্তি বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অবশ্য যারা চুক্তি করে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি কিন্তু কিছু অগ্রগতি হয়েছে, শেষ করার চেষ্টা করছে, তাদের সুযোগ দেয়া হবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে কোন কাজ করতে না পারায় সরকারের লক্ষ পূরণ এখনই হোঁচট খেয়েছে। গত কয়েকবছর সরকারের সাথে চুক্তি হওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৫/১৬ সালের মধ্যে যেসব কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা এমন অনেক কেন্দ্রর এখনও কোন কাজই শুরু হয়নি। এমনকি ২০১৪ সালে উৎপাদনে আসার কথা ছিল যার তারও অগ্রগতি শুন্য। ২০১৭ সালের মধ্যে উৎপাদন করার অঙ্গিকার করে সাত হাজার ৩০৮ মেগাওয়াটের চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু এরমধ্যে তিন হাজার ৯২৯ মেগাওয়াটের কাজই শুরু করতে পারেনি। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রর অর্থ সংস্থানও হয়নি। এরমধ্যে সরকারি প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট। বাকীটা বেসরকারি।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত জাতীয় গ্রীডে মোট যোগ হয়েছে পাঁচ হাজার ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এরমধ্যে সরকারিখাতে ২১টি থেকে দুই হাজার ২৪৯ মেগাওয়াট এবং বেসরকারিখাতে ৪০টি থেকে দুই হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। এছাড়া ৫০০ মেগাওয়াট ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। যে কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে তারমধ্যে গ্যাস ভিত্তিক দুই হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট এবং তরল জ্বালানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুই হাজার ২৪৯ মেগাওয়াট। এই সব কেন্দ্রর মধ্যে বেশিরভাগই নিদিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়ায় আনা ছোট কেন্দ্র। আর সরকারি কেন্দ্রর মধ্যে বেশিরভাগ শুধু সন্ধ্যার সময় চালানোর জন্য। ফলে স্থায়ী বড় কেন্দ্র সন্তোষজনক হারে উৎপাদনে আসেনি। এছাড়া যেগুলো উৎপাদনে এসেছে তারমধ্যে বেশি খরচ বলে বছরের বেশি সময় তেল চালিতগুলো বল্পব্দ থাকে। আর গ্যাস থাকে না বলে গ্যাস চালিতগুলো বন্ধ থাকে।
২০০৯ থেকে ২০১৪ মে পর্যন্ত ১০ হাজার ৮৯৯ মেগাওয়াটের ৭৫টি কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হয়েছে। এরমধ্যে ৪০টি কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে যার উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার ৫৯১ মেগাওয়াট। এরমধ্যে ভাড়ায় আনা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০টি। যার উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ৬৫৩ মেগাওয়াট। এছাড়া সরকারি ১৭টি কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে যার উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ৭৮৫ মেগাওয়াট। এগুলোর বেশিরভাগই শুধু সন্ধ্যায় চালানোর জন্য। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে মাত্র তিনটি যার উৎপাদন ক্ষমতাও মাত্র ১৫৩ মেগাওয়াট।
সরকারি যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে কোন কাজই হয়নি সেগুলো হলো, খুলনা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং এ ক্ষমতা বাড়িয়ে ২২৫ মেগাওয়াট করা, বিবিয়ানা ৪০০ মেগাওয়াট (৩য় ইউনিট), চাপাই নবাবগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, শাহাজীবাজার ৩৩২ মেগাওয়াট, ঘোড়াশাল ৩৬৩ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জ ৩৮১ মেগাওয়াট, এবং বড়পুকুরিয়া ২৭৫ মেগাওয়াট। মোট এক হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট। বেসরকারিভাগে যেসব কেন্দ্র স্থাপনে কোন কাজ হয়নি তা হলো, সিরাজগঞ্জ ২১৮ মেগাওয়াট, কক্সবাজার বায়ু বিদ্যুৎ ৬০ মেগাওয়াট, সবিলা ১০৮ মেগাওয়াট, গাবতলি ১০৮ মেগাওয়াট, জামালপুর ৯৫ মেগাওয়াট, কেরানীগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট এবং বসিলা ১০৮ মেগাওয়াট। মোট ৮৫২ মেগাওয়াট। আমদানি করা কয়লা দিয়ে বেসরকারি খাতে দুটো কেন্দ্র করার কথা ছিল। ২০১২ সালে এদুটোর চুক্তি হয়েছে। একটি ৫২২ মেগাওয়াট অন্যটি ৬৩০ মেগাওয়াট। মোট এক হাজার ১৫২ মেগাওয়াট। এই দুই কেন্দ্রর অর্থের সংস্থান এখনো হয়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রর চুক্তি বাতিল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব কেন্দ্র স্থাপনের নির্ধারিত সময় শেষ হয়েছে। বাড়তি সময়েও কেন্দ্র স্থাপনের কোন কাজ করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এসব কেন্দ্র বাতিলের সুপারিশও করা হয়েছে। ২০১১ সালে এসব কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করা হয়েছে। প্রায় তিন বছর হয়ে গেলেও কোন কাজই করতে পারেনি এসব কেন্দ্রর উদ্যোক্তারা।
যে কেন্দ্রগুলো বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে তাহলো, বসিলার ১০৮ মেগাওয়াট করে দুটি কেন্দ্র, গাবতলী ১০৮ মেগাওয়াট, নারায়ণগঞ্জ ৫১ মেগাওয়াট, মানিকগঞ্জ ৫৫ মেগাওয়াট, নারায়ণগঞ্জ ৫৫ মেগাওয়াট, টাঙ্গাইল ২২ মেগাওয়াট, কালিয়াকৈর ১৪৯ মেগাওয়াট, সাতক্ষীরা ৫৪ মেগাওয়াট এবং কমলাঘাট ৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ স¤ক্সদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতসপ্তাহে এবিষয়ে বলেন, যেসব উদ্যোক্তারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য সরকারের সাথে চুক্তি করেছে কিন্তু কোন কাজই করতে পারেনি তাদের চুক্তি বাতিল করা হবে। খুব দ্র“ত সময়ের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর যারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে কিন্তু নিদিষ্ট সময়ে উৎপাদনে আনতে পারছে না তাদের কাছ থেকে জরিমানা নেয়া হবে। তিনি বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ি বিদ্যুৎ উৎপাদন ঠিক রাখতে যতগুলো কেন্দ্র বাতিল করা হবে সমপরিমান আবার নতুন করে অনুমোদন দেয়া হবে।
সহৃত্র জানায়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার চুক্তির সময় সরকারের কাছে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ জমানত রাখতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে কেন্দ্র স্থাপন করলে এই অর্থ ফেরত দেয়া হয়। আর স্থাপন করতে না পারলে অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়। কিংবা কোন জরিমানার প্রয়োজন হলে ঐ অর্থ থেকে কেটে নেয়া হয়। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অন্য সকল চুক্তির ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মানা হয়।
অল্প কিছু কেন্দ্র আছে যার কাজ শেষ পর্যায়ে। এমন সরকারি কেন্দ্রর মধ্যে আছে সিরাজগঞ্জ ১৫০ কে ২২৫ মেগাওয়াটে উন্নিত করা। এই কেন্দ্রর কাজ ৯৩ ভাগ শেষ হয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রর কাজ ৫৬ ভাগ হয়েছে। এছাড়া আশুগঞ্জ ৩৭৩ মেগাওয়াটের ৩৩ ভাগ এবং কড্ডা ১৫০ মেগাওয়াটের ৩০ ভাগ কাজ হয়েছে।
বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ভাল অবস্থায় আছে ঘোড়াশাল ১০৮ মেগাওয়াট কেন্দ্র। এই কেন্দ্রর পরীক্ষামূলক উৎপাদন চলছে। গগননগর ১০২ মেগাওয়াট এর কাজও প্রায় শেস পর্যায়ে। এছাড়া, কাঠপট্টি মুন্সিগঞ্জ ৫৩ মেগাওয়াটের ৮০ ভাগ, পটিয়া চট্টগ্রাম ১০৮ মেগাওয়াট ৯১ ভাগ কাজ হয়েছে। মেঘনাঘাট ৪৫০ (২য় ইউনিট) মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই কেন্দ্র স্থাপনের কাজ হয়েছে ৮১ ভাগ।
বর্তমানে নির্মানাধীন সাত হাজার ৩০৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ৩৫টি কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এরমধ্যে সরকারি ১৫টির উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার ৯০২ মেগাওয়াট এবং বেসরকারি ২০টির উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার ৪০৬ মেগাওয়াট। দরপত্র প্রক্রিয়াধীন আছে ২১টি কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ হাজার ২৬৪ মেগাওয়াট। এরমধ্যে বেশিরভাগই বেসরকারি। বেসরকারি কেন্দ্রর সংখ্যা ১৬টি যার উৎপাদন ক্ষমতা চার হাজার ৮৮ মেগাওয়াট। বেসরকারি পাঁচটি যার উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ১৭৬ মেগাওয়াট। আর পরিকল্পনায় আছে আরও আটটি কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার ৪৭৯ মেগাওয়াট। এরমধ্যে মাত্র ১০০ মেগাওয়াটের একটি বেসরকারি ছাড়া সবই সরকারি।