চুরি বন্ধ করতে পারলে গ্যাসের দাম কম বাড়ালে চলতো

পেট্রোবাংলা গ্যাস বিক্রি করছে প্রতি ঘনফুট সাড়ে ৭ টাকায়। আর আমরা যা আমদানি করছি তার দাম পড়ছে ৩২ টাকা। দেশে এই মুহূর্তে আমদানি করা হচ্ছে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট আর উৎপাদন করা হচ্ছে ২৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এই ৩২ টাকার গ্যাস যদি সাড়ে সাত টাকায় বিক্রি করতে হয় তাহলে যে অতিরিক্ত টাকা আমাদের আমদানি করতে প্রয়োজন হচ্ছে তা উঠে আসবে না। তাই, আমরা যদি গ্যাস আমদানি করি তাহলে এর দাম অবশ্যই বাড়াতে হবে। আগে তো গ্যাস বিনা পয়সায় দেওয়া হয়েছে। তাই আমাদের একটি প্রত্যাশা দাঁড়িয়েছে যে এখনো গ্যাস বিনা পয়সায় পাওয়া যাবে।

গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে কী কী সঙ্কট তৈরি হবে বলে আপনি মনে করেন?- “গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে। কারখানার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কম মুনাফা করে তারা লোকসানের মুখে পড়ে কারখানা বন্ধ করে দিলে দেশে বেকারের সংখ্যা আরো বাড়বে।

তবে বাসাবাড়ির কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়টি আমি যৌক্তিক মনে করি। দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসায় গ্যাস ব্যবহার করেন। একটি বাড়িতে সারা মাসের জ্বালানি খরচ এক হাজার টাকা হওয়াটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়। যেহেতু বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় বা এ বিষয়ে লোকজনকে সমবেত করা যায় সেহেতু তারা এই ১০০ বা ১৫০ টাকা বৃদ্ধি নিয়ে হৈচৈ করেন। তারা মনে করেন এর ফলে মধ্যবিত্তের ওপর বিরাট চাপ পড়বে। আসলে কিন্তু তা নয়। লোকজন মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্য কেনায় যে পরিমাণ টাকা খরচ করেন সেই হিসাবে মাসে গ্যাসের দাম ১০০ বা ১৫০ বৃদ্ধি আসলে কিছুই না।

পরিবহণখাতে সিএনজির দাম যে সামান্য পরিমাণে বেড়েছে তাতে ভাড়া বাড়ানো উচিত নয়। কেননা, ইতোমধ্যেই পরিবহন মালিকরা বেশি ভাড়া আদায় করছেন।

আর প্রত্যেক বাসায় ১ হাজার টাকার গ্যাস ব্যবহার করা হয় না। যারা প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন তাদের অনেকের গ্যাস ব্যবহার হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। প্রিপেইড মিটার নিলে অনেকের ৪০ শতাংশ খরচ কমে যায়। তাই বলা যায়, সরকার সবার জন্যে সমান দাম ধরে যে টাকা আদায় করছে তা অনেক বেশি আদায় করছে। টাকাটা চুরি নামের ভর্তুকিতে ঢুকছে।

এলএনজি আসার আগে সিস্টেম লস বা চুরি ছিলো ৩ শতাংশ। এখন সেই চুরি ১২ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। অর্থাৎ, ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চুরি হচ্ছে। এর দাম আমদানি মূল্যের হিসাবে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এখন এই চুরি যদি সরকার বন্ধ করতে পারতো তাহলে গ্যাসের দাম হয়তো আমদানি মূল্যের হিসাবে সামান্য বৃদ্ধি করলেই হতো। তাই গ্যাস চুরি বন্ধ করতে হবে।

গ্যাসের দাম যদি আন্তর্জাতিক বাজারে কমে যায় তাহলে দেশেও কমানো উচিত। কিন্তু, দেশে দাম কমাতে হলে রেগুলেশন ঠিক করতে হবে। সঠিক মিটারিং লাগবে। চুরি বন্ধ করতে হবে। তাহলে গ্যাসের দাম কমানো যাবে। সরকার সবসময়ই চিন্তা করে কীভাবে বেশি রাজস্ব আয় করা যায়। আর কোনো কিছুতে সরকার ভর্তুকি দিলে তখন সঠিক দাম নির্ধারণ করা যায় না।

গ্যাসে এই মুহূর্তে কোনো ভর্তুকি নেই। তবে আমদানিকৃত এলএনজিতে ভর্তুকি দেয়া হতে পারে। সেই ভর্তুকি কমাতে গ্যাসের দাম হয়তো বাড়ানো হয়েছে। পেট্রোবাংলা লোকসান করে। কিন্তু, বিপণন সংস্থা হিসেবে তিতাসের কোনো লোকসান নেই। তারা এখনো টাকা বানিয়ে যাচ্ছে।

আমরা সবসময়ই স্পট থেকে গ্যাস কিনি না। আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম দেখি সেটি সেই সময়ের ‘স্পট প্রাইজ’। অর্থাৎ, সেই দিনের দাম। কিন্তু যখন দীর্ঘ সময়ের জন্যে গ্যাস কেনার চুক্তি করা হয় তখন একটি নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একটি দেশের ন্যূনতম গ্যাসের ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে সাধারণত সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জন্যে চুক্তি করতে হয়। সর্বনিম্ন সময় হচ্ছে ছয় মাস। আমাদের সরকার চুক্তি করেছে দীর্ঘ মেয়াদের জন্যে। এখন গ্যাস সরবরাহের কারণে হয়তো দাম কমে গেছে। এর মানে এই নয় যে আমার সেই চুক্তি বাদ দিয়ে কম টাকায় সেই দিনের বাজার দরে গ্যাস কিনবো। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের দাম কমার সঙ্গে আমাদের দেশের দাম মেলালে হবে না।

আমরা যখন প্রশাসনিকভাবে দাম নির্ধারণ করা বন্ধ করে দিবো, তখন আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের সঙ্গে মিল রেখে দাম নির্ধারণ করতে পারবো।

ম. তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক