জ্বালানিখাত: চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রত্যয়

এ বি এম আবদুল ফাত্তাহ্:

সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় উন্নয়নের মহাসড়কে এখন বাংলাদেশ। ‘তলাবিহীনঝুড়ি’ বলে একদিন যে দেশকে অবজ্ঞা করা হয়েছে, সে দেশ বিশ্ববাসীর কাছে এখন ‘উন্নয়ন-বিস্ময়’; বাংলাদেশের আর্থ-সামজিক অগ্রযাত্রা এখন বিশ্বের রোল মডেল। সরকারের বিভিন্ন বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মানউন্নয়নের সাথে জ্বালানির চাহিদাও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদাপূরণের লক্ষ্যে সরকার দেশজ জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা আহরণ ও উৎপাদন এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে।
বিশ্বব্যাপী মহামারী সৃষ্টিকারী ভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও জনস্বাস্থ্য ও জনজীবন নানা সংকটের সম্মুখীন। এ অবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস অনুসন্ধান, উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, এলএনজি আমদানি ও কয়লার উৎপাদন কঠিন চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে অর্জিত অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার ওপর বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও এর আওতাধীন বিশেষায়িত কোম্পানিগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী নিরলসভাবে কাজ করছে।

সাইসমিক সার্ভে: স্থলভাগে নতুন গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্স এর দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক সাইসমিক সার্ভে টিমকে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দ্বারা সজ্জিত করা হয়। বাপেক্স নতুন নতুন গ্যাসস্তর আবিষ্কারের মাধ্যমে সাফল্যের প্রমাণ রেখেছে।
অনুসন্ধান কূপ: বর্তমান সরকারের সময়ে দেশে মোট ১৯টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। এর ফলে গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা ২০০৯ সালের ২৩টি হতে বর্তমানে ২৭টিতে উন্নীত হয়েছে।

একনজরে গ্যাস সেক্টর (জুন, ২০২১)

বিবরণ                                                                                সংখ্যা/পরিমাণ
মোট গ্যাসক্ষেত্র                                                                    ২৭টি
মোট উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্র                                             ২০টি
উৎপাদনরত মোট কূপের সংখ্যা                                       ১০৬টি
গ্যাস উৎপাদন ক্ষমতা                                                          ২,৭৫২ এমএমসিএফডি
রি-গ্যাসিফাইড এলএনজি সরবরাহ ক্ষমতা                      ১,০০০ এমএমসিএফডি
সর্বোচ্চ গ্যাসউ ৎপাদন (০৬ মে, ২০১৫)                           ২,৭৮৫.৮০ এমএমসিএফডি
মোট প্রাক্কলিত গ্যাসের মজুদ (প্রমাণিত + সম্ভাব্য)           ২৮.২৯ টিসিএফ(ডিসেম্বর, ২০২০)
প্রারম্ভ হতে মোট গ্যাস উৎপাদন                                         ১৮.২৪ টিসিএফ (ডিসেম্বর, ২০২০)
অবশিষ্ট গ্যাসের মজুদ (প্রমাণিত + সম্ভাব্য)                     ১০.০৫ টিসিএফ (জানুয়ারি, ২০২১)
দৈনিক চাহিদা                                                                      ৩,৬৫৮ এমএমসিএফডি
গ্রাহক সংখ্যা                                                                        ৪৩ লক্ষ

প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ: ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে গ্যাসের উৎপাদন ছিল দৈনিক ১,৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট।
দেশীয় উৎপাদিত গ্যাস ও আমদানি করা এলএনজিসহ বর্তমানে দৈনিক গড়ে সরবরাহ ৩,২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট, সরবরাহ বেড়েছে ১,৫০৬ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে ৮টি গ্রাহক শ্রেণিতে, যথা – বিদ্যুৎ, সার, শিল্প, বাণিজ্যিক, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সিএনজি, চা বাগান এবং আবাসিক-এ প্রায় ৪৩ লাখ গ্রাহককে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চলে; যেমন: বেজা, ইপিজেড, বিসিক ইত্যাদিতে গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে গ্যাস অবকাঠামো নির্মাণে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে দেশের একমাত্র অনুসন্ধান ও উৎপাদন কোম্পানি বাপেক্স এর কারিগরী সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে গভীর কূপ খননের ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি রিগ সংগ্রহ করা হয়েছে এবং আরও ১টি রিগ মেরামত করা হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে ৪৫টি উন্নয়ন কূপ খনন এবং ২৯টি কূপের ওয়ার্কওভারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কার্যক্রম চলছে।

পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন: দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রাপ্ত গ্যাস কনডেনসেট সমৃদ্ধ হওয়ায় এ অঞ্চলের অধিকাংশ গ্যাসক্ষেত্রে শুরু থেকে ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টে কনডেনসেট প্রক্রিয়াকরণ করে পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন জাতীয় পেট্রোলিয়াম পদার্থ উৎপাদন করা হচ্ছে। গ্যাস উপজাত কনডেনসেট প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে উৎপাদিত পেট্রোল দেশের চাহিদা পূরণে সমর্থ হচ্ছে এবং অকটেন চাহিদার বৃহদাংশ পূরণ করছে।

সঞ্চালন পাইপলাইন: ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ২২২ কিলোমিটার সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এই সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণের ফলে মোট গ্যাস সঞ্চালন ক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাইপলাইনের সঞ্চালন ক্ষমতা আরও বাড়ানোর প্রকল্প পরিকল্পনাধীন।
প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি): খুব শীঘ্রই ব্লক এসএস-০৪ এ অনুসন্ধানকূপ খনন কার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়াও, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে এসএস-০৪ এবং এসএস-০৯ ব্লকে আরও ২টি অনুসন্ধানকূপ খনন করা হবে। বর্তমানে পিএসসি আওতাধীন ৪টি গাসক্ষেত্র থেকে মোট উৎপাদনের ৬৭ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে।
এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ ও আমদানি: দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে এবং স্পটমার্কেট থেকেও এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। কক্সবাজারের মাতারবাড়ী এলাকায় স্থলভাগে দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতার একটি এলএনজি টার্মিণাল নির্মাণ করতে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ এর আওতায় অনুমোদন পাওয়া গেছে।

বাপেক্স শক্তিশালীকরণ: ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে বাপেক্সকে যুগোপযোগী ও আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সাংগঠনিক কাঠামো প্রণয়ন করা হয়েছে। বাপেক্স এর অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রাখার স্বার্থে ভূতাত্ত্বিক জরিপ, ২ডি সাইসমিক জরিপ এবং ৩ডি সাইসমিক জরিপ, অনুসন্ধান কূপ, উন্নয়ন কূপ, ওয়ার্কওভার কূপ খননের ৩ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

কয়লা উত্তোলন: বাংলাদেশে এযাবৎ ৫টি কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে যার মোট সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ প্রায় ৭,৮০৩ মিলিয়ন মেট্রিকটন। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তরাংশ থেকে কয়লা উত্তোলনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভূগর্ভে প্রায় ৫,৮০০ মিটার রোডওয়ে নির্মাণ সাপেক্ষে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হবে বলে আশা করা যায়। গতবছরের সমীক্ষা অনুযায়ী দীঘিপাড়া কয়লাক্ষেত্রের ১১ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মোট ৭০৬ মিলিয়ন মেট্রিকটন কয়লা মজুদ আছে, যারমধ্যে ৯০ মিলিয়ন মেট্রিকটন ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে উত্তোলনযোগ্য।

গ্রানাইট পাথর উত্তোলন: মধ্যপাড়া গ্রানাইট খনি থেকে গড়ে দৈনিক প্রায় ৫,২০০ মেট্রিকটন (৩ শিফটে) গ্রানাইট শিলা উত্তোলন করা হচ্ছে। নতুন খনির জন্য সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। মধ্যপাড়া খনি থেকে গ্রানাইট পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে পাথরের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় হচ্ছে।

সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা: প্রতিবছর গ্যাসখাত থেকে সরকারি কোষাগারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ যোগান দেয়া হয়ে থাকে। ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছর সিডি/অন্যান্য, ডিএসএল, লভ্যাংশ, আয়কর ও এসডি-ভ্যাট ইত্যাদি বাবদ সরকারি কোষাগারে যথাক্রমে ১৩,১৮৯ কোটি, ১৫,৭২৩ কোটি, ১১,৪৪৩ কোটি, ৬,০৭৭ কোটি ও ৬,০০০ কোটি টাকা (সাময়িক হিসাব অনুসারে) জমা দেয়া হয়েছে।

দেশের প্রাথমিক জ্বালানির অন্যতম উৎস হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা। বর্তমানে ব্যবহৃত বাণিজ্যিক জ্বালানির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস দ্বারা পূরণ করা হয়। এ কারণে প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য। প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে গ্যাসের ঘাটতি দূরীকরণ ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেশীয় সম্পদ আহরণের পাশাপাশি পেট্রোবাংলা বিদেশ হতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে। এমতাবস্থায়, সার্বিক প্রেক্ষাপটে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা সুদৃঢ়করণে পেট্রোবাংলার অবদান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর জ্বালানি নীতি অনুসরণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, নতুন নতুন জ্বালানির উৎস উদ্ভাবন, জ্বালানি সমৃদ্ধ দেশসহ আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশকে উন্নয়ণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখে দেশকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

লেখক: চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)