জ্বালানির দাম ১০ বছরে তিনগুণ বাড়বে: দক্ষতা ও স্বচ্ছতায় কমানো সম্ভব
তরল গ্যাস আমদানির পর পুরো জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে। আগামী ১০ বছরে এই দাম তিনগুণ বাড়াতে হবে। তবে দক্ষতা বাড়িয়ে তা কমিয়ে রাখা সম্ভব। বাজার মূল্যে জ্বালানির দাম ঠিক করলেও দরিদ্র মানুষের জন্য ভর্তূকি দিতে হবে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দাম না রাখলে পুরো অর্থনীতিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে।
‘জ্বালানি’র দাম ও জাতীয় অর্থনীতি’ বিষয়ক এক সেমিনারে বক্তারা একথা বলেন। শনিবার বিদ্যুৎ ভবনে ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স, বাংলাদেশ (এফইআরবি) এই সেমিনারের আয়োজন করে।
এতে বক্তারা বলেন, স্বচ্ছভাবে দাম নির্ধারণ করতে হবে। কোন একটা জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য অন্য জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সমন্বিত পরিকল্পনা কৌশল থাকতে হবে।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি অরুণ কর্মকার। স্বাগত বক্তব্য দেন নির্বাহি পরিচালক সদরুল হাসান।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ দেয়া হবে। তবে ভাল বিদ্যুৎ দিতে আরও সময় লাগবে। জ্বালানি চাহিদা মেটাতে ভর্তূকি থাকবে।
তিনি বলেন, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হচ্ছে। এলএনজিতে ভ্যাট মুওকুফ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে খরচ কিছু বাড়বে। পরিবেশের বিষয়ে নজর রাখতে এই খরচ বাড়াতেই হবে।
তিনি বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাচ্ছে। এলএনজি’র দামও কমে যাচ্ছে। ফলে সেদিকে নজর দিতে হবে। বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে। এতে নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে।
মূল প্রবন্ধে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম বিভাগের অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, বাংলাদেশে ভবিষ্যতে জ্বালানির দাম নির্ধারণ কঠিন হবে। অনেক বিষয় জ্বালানির দাম নির্ধারণে প্রভাব ফেলবে। আন্তর্জাতিক বাজার, সরকারের ভর্তূকি, জ্বালানির ব্যবহার, কোন জ্বালানি কতটা ব্যবহার হচ্ছে, দক্ষতার উন্নয়ন ইত্যাদি।
ভবিষ্যতে কেমন দাম হবে বা কোন নিয়মে দাম ঠিক করা হবে তা এখনই পরিস্কার হতে হবে। বিশেষ করে শিল্পখাতের জন্য। ভবিষ্যতে জ্বালানির দাম কেমন হবে তা জানা থাকলে বিনিয়োগে সুবিধা হবে।
ম তামিম বলেন, যে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা ব্যবহার শুরু হলে আড়াই গুণ গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। আর আগামী ১০ বছরে গ্যাসের দাম তিনগুণ বাড়াতে হবে। তবে ব্যবহার ও সরবরাহ দক্ষতা বাড়িয়ে এই দাম বাড়ানো নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ক্যাপটিভ বন্ধ করে শিল্পে পুরো গ্রিডের বিদ্যুৎ দিতে হবে। পদ্ধতিগত লোকসান কমাতে হবে। সঞ্চালনে লোকসান কমানো সম্ভব। পল্লী বিদ্যুতে লোকসান সবচেয়ে বেশি। জ্বালানি তেলের চাহিদা কমাতে পরিবহনে পরিবর্তন আনতে হবে। পুরানো পরিবহন পরিবর্তন করতে হবে। অদক্ষতার কারণে বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা তোলার খরচ বাড়ছে। ১৯৯০ সালের পরে বিদ্যুতের জন্য গ্যাসের দাম বাড়েনি।
তিনি বলেন, বাজারমূল্যে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে। তবে বাজারমূল্যে দিতে গিয়ে যেন জনগণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এমনভাবে জ্বালানির মূল্য ঠিক করতে হবে যেন বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারে কেউ বঞ্চিত না হয়। বাজার এমন হতে হবে যেন, যার কাছে যেটা সহজ মনে হবে সে সেটা ব্যবহার করতে পারে। পাইপ লাইনের গ্যাসের সাথে এলপিজি’র দাম সমন্বয় করতে হবে। যার যেটা পছন্দ হবে সে সেটা ব্যবহার করবে। তিনি বলেন, কোন অবস্থাতেই জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রভাব বিস্তার করা উচিত নয়। সব বাজার মূল্যে রাখা উচিত। কোন বিশেষ জ্বালানিকে উৎসাহিত করা উচিত নয়। এক জ্বালানির সাথে অন্য জ্বালানির দাম সমন্বয় করতে হবে। সব জ্বালানির দাম তেলের সাথে সমন্বয় করলে ভাল বলে তিনি জানান। বাজারমূল্যে জ্বালানি দিয়ে নিদিষ্ট গোষ্টির জন্য ভর্তূকি দিতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ আর জ্বালানি নিরাপত্তা এই তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জ্বালানির দাম ঠিক করতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে জ্বালানি এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যেন বিদ্যুৎ উৎপাদন সব সময় কম খরচে হয়। কারণ বিদ্যুতের দাম সময় সময় প্রাথমিক জ্বালানির দামের উপর নির্ভর করে। অনুমান করা যায়, আগামি কয়েকবছর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়বে না। সেদিকে খেয়াল রেখে জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, প্রাথমিক জ্বালানির দাম পরিবর্তন হলে বিদ্যুতের দামও পরিবর্তন হবে। তবে জ্বালানির দাম সব সময় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। এজন্য কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং আমদানির উপর জোর দিতে হবে। এইখাতে কর মওকুফ করে সুবিধা দেয়া যেতে পারে। শিল্পে ভর্তূকি কমিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য দেয়া যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে ভর্তূকি তুলে দিতে হবে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবি) চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুরোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, সকল মানুষের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এর দাম নির্ধারণে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে অনেক মানুষেরই ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। তখন বিশৃংখলা তৈরি হবে। এজন্য ক্ষেত্র বিশেষে জ্বালানির দাম নির্ধারণে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এর উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, স্বচ্ছভাবে পরিকল্পনা ও নীতি ঠিক করতে হবে। সব সমস্যার সমাধান শুধু দাম বাড়িয়ে করলে হবে না। বিদ্যুতের দাম পাঁচভাগ বাড়লে জীবনযাত্রার অন্য খরচ আরও ২০ ভাগ বেড়ে যায়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার ঘাটতি আছে। সরকারি প্রকল্পে না দিয়ে অনেক সুবিধা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মত সরকারি কেন্দ্রে সুবিধা দিলে উৎপাদন খরচ কমে যেত। ভাড়ায় আনা অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চুক্তি নবায়ন করা হলেও দাম কমানো হয়নি বলে তিনি অভিযোগ করেন। তবে প্রতিমন্ত্রী সে অভিযোগ ঠিক নয় বলে জানান।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার এসোসিয়েশনের সহসভাপতি ইমরান করিম বলেন, গ্যাস ব্যবহার না করেও বিল দিতে হচ্ছে। এজন্য শিল্পে যথাযথ মিটার দিতে হবে। দামের সাথে উন্নত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।