সুযোগ থাকলেও বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বছরে ক্ষতি ৭৮৪৩ কোটি টাকা
কম খরচে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এজন্য ভোক্তারা বছরে সাত হাজার ৮৪৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বিদ্যুতের মূল্য পরিবর্তনের ওপর গণশুনানির সমাপনী দিনে এ তথ্য এবং প্রস্তাব তুলে ধরে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
প্রস্তাবে বলা হয়, খরচগুলো সমন্বয় করা হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম ৬ পয়সা কমানো সম্ভব। আর উৎপাদন খরচ কমালে প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১ টাকা ৩২ পয়সা পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
বিদ্যুতের দাম কমাতে ক্যাবের প্রস্তাবের ওপর শুনানি গ্রহণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এর আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়াতে পিডিবির প্রস্তাবের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর গত বুধবার পর্যন্ত বিতরণ সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর খুচরা দাম বাড়ানোর শুনানি করা হয়।
বিদ্যুতের দাম ১ টাকা ৩২ পয়সা কমানোর প্রস্তাব : ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম তার প্রস্তাবনায় দেখান, পাইকারি বিদ্যুতের দাম ৭২ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাবে রাজস্ব চাহিদায় প্রতি ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিদ্যুত্ উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা, পাইকারি বিদ্যুতের দামহারে ঘাটতি ৫ পয়সা। এ ছাড়া দরপতন সমন্বয়কৃত মূল্যহারে ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে মেঘনাঘাট আইপিপিতে ডিজেল ব্যবহারের ঘাটতি ১৪ পয়সা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে আয়হারে অন্তর্ভুক্ত হয়নি ভোক্তাপর্যায়ে ১৩২ কেভি লেভেলে বিদ্যুত্ বিক্রিতে উদ্বৃত্ত আয় ৮ পয়সা এবং পাওয়ার ফ্যাক্টর জরিমানা আদায় বাবদ আয় ৪ পয়সা। সবমিলিয়ে এই ৭৮ পয়সা প্রস্তাবিত দামহার বৃদ্ধির সঙ্গেও যদি সমন্বয় করা হয় তবে বার্ষিক ৩২১ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। ফলে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে ৭২ পয়সা বাড়ানো নয়, ৬ পয়সা কমানো যায়।
তিনি বলেন, সরকার কমদক্ষ এবং বেসরকারি রেন্টাল বিদ্যুতে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুতের উত্পাদন খরচ বাড়াচ্ছে। অথচ পিডিবির বিদ্যুেকন্দ্রগুলো গ্যাসের অভাবে অপেক্ষাকৃত কম খরচের বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে পারছে না। ওই গ্যাস পিডিবি পেলে কম খরচে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যায়। প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জনগণের ওপর খরচের বোঝা চাপিয়েই যাচ্ছে সরকার। এই দুর্নীতি বন্ধ এবং নীতিগত ভুল সংশোধন করতে হবে।
পাইকারি বিদ্যুতের দামহারে ২ বছরে ৪ ধাপে উদ্বৃত্ত ১ টাকা ৩২ পয়সা সমন্বয় করে বর্তমান দাম ৪ টাকা ৯০ পয়সা থেকে কমিয়ে ৩ টাকা ৫৮ পয়সা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও নীতিগত ভুলের মাশুল বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে দিতে হচ্ছে জনগণকে। অন্যায্যভাবে উত্পাদন খরচ বাড়িয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অন্যায় ও অযৌক্তিক।
শামসুল আলম বিদ্যুত্ খাতের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে বলেন, বিনা দরপত্রে অমীমাংসিতভাবে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে সেগুলোতে কারিগরি ও আর্থিক দুর্নীতি হচ্ছে। এগুলো নির্মাণে যে ব্যয় দেখানো হচ্ছে প্রকৃত ব্যয় তার চেয়েও অন্তত অর্ধেক কম।
শর্তসাপেক্ষে কমানো সম্ভব, জানালো পিডিবি :
ক্যাবের প্রস্তাবের বিপরীতে কোনো মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেয়নি বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। তবে ক্যাবের প্রস্তাব ও বক্তব্যের বিপরীতে বক্তব্য উপস্থাপন ও প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন পিডিবির মহাব্যবস্থাপক কাওসার আমীর আলীসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। পিডিবি বলে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন হার ১ টাকা ৩২ পয়সা উদ্বৃত্ত থাকার হিসাব বাস্তবসম্মত নয়। তবে ব্যয়ে অন্তর্ভুক্ত বিদ্যুত্ উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা, ১৩২ কেভি লেভেলে গ্রাহক সিঙ্গেল বায়ারের অধীন অন্তর্ভুক্ত করলে ৮ পয়সা অর্থাত্ মোট ৫৫ পয়সা সমন্বয় করা হলে এবং বার্ষিক ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হলে কম বিদ্যুৎ দেয়া যাবে।
সরকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয় :শুনানিতে অংশ নিয়ে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সরকারি সেবার ক্ষেত্রে নয়। মানুষ কর-ভ্যাটের মাধ্যমে সরকারকে টাকা দিচ্ছে। তা থেকে এ খাতে বরাদ্দ দিতে হবে, ভর্তুকি নয়।
কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মাকসুদ বলেন, সরকার অনেক সময় খেয়াল-খুশি মতো কিছু কিছু জিনিসের দাম বাড়ানোতে সহযোগিতা করে কিংবা নিজেই বাড়িয়ে দেয়। একটি গণতান্ত্রিক সরকার মানুষের বোঝা কমাবে কিন্তু বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে না। সরকার কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, তারা বলতে পারে না এক্ষেত্রে লাভ কিংবা লোকসান হচ্ছে। সংবেদনশীলতার সঙ্গে যাচাই না করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তা হবে জনগণকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার শামিল।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, বিদ্যুত্ একটি কৌশলগত পণ্য এবং এটির দাম বেড়ে গেলে অন্য সব পণ্যের উত্পাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে দুটি প্রতিক্রিয়া হয়। একটি মুদ্রাস্ফীতি, এতে জনগণের প্রকৃত আয় কমে যায় এবং অন্যটি দেশের পণ্যের উত্পাদন খরচ বেড়ে যায়। এতে রপ্তানিখাত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যায়। তাই বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব হলে তা কমানো দরকার।
গণশুনানি পরিচালনা করেন বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম। শুনানিতে আরো উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য রহমান মুরশেদ, মাহমুদউল হক ভুইয়া, আব্দুল আজিজ খান ও মিজানুর রহমান। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আমজাদ হোসেন, সিপিবির সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতির সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি।