জ্বালানি তেলের দরপতন ও আমাদের করণীয়

সম্প্রতি ‘জ্বালানি তেলের নিম্নমূল্যের সুযোগ’ শিরোনামের একটি আকর্ষণীয় নিবন্ধে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনসের কেমাল দারভিস উন্নত দেশসমূহে কার্বন ট্যাক্স আরোপের প্রস্তাব করেছেন। তাঁর যুক্তিগুলো হলো, জ্বালানি তেলের মূল্যের ক্রমাগত হ্রাসের ফলে নবায়নযোগ্য শক্তির মূল্য অপ্রতিযোগী হয়ে পড়বে এবং এ খাতে বিনিয়োগ ও গবেষণা বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রতিযোগিতার দৌড়ে আরও পিছিয়ে পড়বে; জ্বালানি তেলের মূল্য পড়ে যাওয়ার কারণে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক ভোক্তারা জ্বালানিসাশ্রয়ী ব্যবস্থা বাস্তবায়নে নিরুৎসাহিত হবে। তাই জ্বালানি তেলের বর্তমান নিম্নমূল্য, গ্রাহক পর্যায়ে তেলের মূল্য না বাড়িয়ে কার্বন ট্যাক্স আরোপের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। বাংলাদেশ পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির অন্যতম শিকার হলেও পরিবেশ দূষণকারী দেশের তালিকায় অবস্থান নিচের দিকে। তাই জ্বালানি তেলের মূল্যের ক্রমাগত হ্রাসের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপটও এখানে ভিন্ন। এতদ্‌সত্ত্বেও জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের করণীয় কী, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তবে সে আলোচনায় যাওয়ার আগে জ্বালানি তেলের মূল্যের প্রবণতা বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। তেলের মূল্য হ্রাসের কারণ নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। একদিকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং জ্বালানিসাশ্রয়ী ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কারণে তেলের চাহিদা কমেছে। অন্যদিকে ইরাক ও লিবিয়ায় অস্থিরতা সত্ত্বেও সেখানে উৎপাদন কমেনি। এ ছাড়া তেলের মূল্য কমিয়ে, জ্বালানি কারটেল ওপেক বিশেষত সৌদিরা (ক) যুক্তরাষ্ট্রের শেইল গ্যাসের উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ঠেকাতে চাইছে, বিদ্যমান প্রযুক্তিতে ৬০ মার্কিন ডলারের নিচে শেইল গ্যাস উৎপাদন লাভজনক নয় বলে মনে করা হয়; (খ) জ্বালানি বাজার নিয়ে ইরান ও রাশিয়ার ‘অশুভ’ আঁতাত ভেঙে দিতে চাইছে। উল্লেখ্য, সৌদিতে তেল উৎপাদন ব্যয় সবচেয়ে কম, প্রতি ব্যারেল মাত্র পাঁচ-ছয় ডলার। সৌদিরা চাইলে সরবরাহ হ্রাস করে তেলের মূল্য বাড়াতে পারে। সে ক্ষেত্রে উপকৃত হবে রাশিয়া ও ইরান, যা তাদের কাম্য নয়। বলা বাহুল্য, চাহিদা ও সরবরাহ ছাড়াও জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূ–রাজনীতি একটি বিরাট নিয়ামক।

ওপেক সৃষ্টির পরবর্তী ৪০ বছরের বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যের প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে তিনটি সুনির্দিষ্ট সময় বিভাজন দেখা যায়: (ক) ১৯৭৪-৮৫ সাল। এ সময়ে তেলের মূল্য, বর্তমান মূল্য ৪৮-১২০ মার্কিন ডলার, এ বন্ধনীতে ওঠানামা করেছে। (খ) কেবল ১৯৯৮ সালের রাশিয়ান সংকট এবং ১৯৯১ সালের ইরাকযুদ্ধের সময় ব্যতীত, ১৯৮৬-২০০৪ সময়কালে তেলের মূল্য ছিল বর্তমান মূল্যে ২১-৪৮ মার্কিন ডলার। (গ) ২০০৮-০৯-এর বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার সময় দুটি সাময়িক উল্লম্ফন ছাড়া ২০০৫ থেকে বর্তমান সময়ে তেল ৫০-১২০ মার্কিন ডলারে বেচাকেনা হয়েছে। বিশ্লেষকেরা এ প্রবণতাকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। ২১-৪৮ মার্কিন ডলার তেলের মূল্যকে তাঁরা প্রতিযোগিতামূলক মূল্য অর্থাৎ প্রান্তিক উৎপাদন ব্যয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত মূল্য বলেছেন। আর ৪৮-১২০ মার্কিন ডলার তেলের মূল্যকে ওপেক–নির্ধারিত একচেটিয়া মূল্য বলেছেন।

এখন প্রশ্ন হলো, তেলের মূল্য কি ২১-৪৮ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ প্রান্তিক উৎপাদন ব্যয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে থাকবে, নাকি আবার ওপেক–নির্ধারিত একচেটিয়া মূল্য ৪৮-১২০ মার্কিন ডলারে ফিরে যাবে? এটা অকল্পনীয় যে অল্প কয়েক মাসের তেলের দরপতনের মাধ্যমে সৌদিরা যুক্তরাষ্ট্রের শেইল গ্যাসের উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ঠেকাতে বা জ্বালানি বাজার নিয়ে ইরান ও রাশিয়ার ‘অশুভ’ আঁতাত ভেঙে দিতে সক্ষম হবে। আবার মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তেলের মূল্য সম্পূর্ণ ওপেক-প্রভাবমুক্ত হয়ে প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে ফিরে যাবে, এটা প্রত্যাশা করাও ঠিক হবে না। সার্বিক বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন যে তেলের মূল্য, দৈব দুর্ঘটনা না ঘটলে, বর্তমান নিম্নপর্যায়ে বেশ কিছুদিন স্থিতিশীল থাকবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের নানা প্রভাব রয়েছে। আমদানিনির্ভর বিধায় একদিকে আমদানি ব্যয় কমবে। এর ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের স্থিতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে ট্যারিফ ভ্যালুর ভিত্তিতে আমদানি পর্যায়ে জ্বালানি তেল থেকে প্রাপ্ত শুল্ক ও করাদি নির্ধারিত হয় বিধায় এ খাতে রাজস্ব আদায় অপরিবর্তিত থাকবে। এমনকি মূল্য হ্রাসের কারণে আমদানি বৃদ্ধি পেলে রাজস্ব বাড়তেও পারে। দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন আমদানি মূল্য হ্রাস এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড জ্বালানি ব্যয় হ্রাসের ফলে বিশেষভাবে উপকৃত হবে।

জুন ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। জুন মাসে তেলের মূল্য ছিল ১১৫ মার্কিন ডলার, বর্তমানে তা কমে ৬০ মার্কিন ডলারের নিচে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের ফলে প্রায় সর্বত্র ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস করা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে অক্টোবর মাস থেকে এ পর্যন্ত পেট্রলের মূল্য আট দফায় এবং ডিজেলের মূল্য চার দফায় কমানো হয়েছে। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসের মূল্য হ্রাসের ফলে দিল্লিতে পেট্রল ও ডিজেলের মূল্য পড়বে যথাক্রমে ৬১ দশমিক ৩৩ ও ৫০ দশ​মিক ৫১ ভারতীয় রুপি। বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারে বাংলাদেশের টাকায় যথাক্রমে ৭৫ দশমিক ৯৯ ও ৬২ দশমিক ৫৮ টাকা। উল্লেখ্য, সর্বশেষ জানুয়ারি ২০১৩ সালে নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী বাংলাদেশে পেট্রল ও ডিজেলের মূল্য যথাক্রমে ৯৬ ও ৬৮ টাকা।

জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস বাংলাদেশে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণকে অবাধ ও প্রতিযোগিতামূলক করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য কিছুটা হ্রাস করে নাগরিক প্রত্যাশা পূরণ এবং অর্থনীতি চাঙা করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিশেষত বাস–ট্রেনের ভাড়া থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহন, এমনকি শাক–সবজির মূল্যের ওপর ডিজেলের মূল্যের পরিবর্তনের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিভিন্ন পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের জন্য প্রদত্ত ভর্তুকি ও পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে মূল্য হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার এবং জ্বালানিসাশ্রয়ী ব্যবস্থা বাস্তবায়ন যাতে নিরুৎসাহিত না হয়, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
অনেক সময়ই বৈরী বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্ভব হয় না। জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস, বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থার অতি প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আমরা আশা করি সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবাই এ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে।

– এম. ফাওজুল কবির খান

সাবেক সচিব, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।