জ্বালানি তেলের দাম যতটা কমল, প্রভাব কতটা পড়বে?
বিডিনিউজ:
জ্বালানি তেলের দাম গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানোর ২৩ দিন পর লিটারে ৫ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তে জনজীবনে কতটুকু হেরফের হবে তা নিয়ে সংশয়ের কথাই উঠে এসেছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়।
আট মাসের ব্যবধানে দুই দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরপরই তড়তড়িয়ে বেড়েছে গণপরিবহনের ভাড়াসহ সব পণ্য ও সেবার দাম। যে হারে বাড়ানো হয়েছে তার তুলনায় নামমাত্র কমানোর কারণে সেটি আগের বেশি বেড়ে যাওয়া মূল্য কমাতে খুব একটা ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন না অনেকেই।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে কারও কারও সন্দেহ ‘বিন্দুমাত্র’ প্রভাব ফেলবে না এটি।
প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের এপ্রিলে ডিজেলের দাম লিটারে তিন টাকা কমানো হয়েছিল।
ওই সময় দূরপাল্লার যাত্রায় প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া এক টাকা ৪৫ পয়সা থেকে কমিয়ে এক টাকা ৪২ পয়সা করা হলেও তা পরে কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর তখন ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের ভাড়ায় রদবদল করা হয়নি।
এবার ডিজেলের দাম লিটারে পাঁচ টাকা কমানোতে পরিবহন মালিকরা জ্বালানি খরচ বাবদ দিনে কয়েকশ’ টাকা সাশ্রয় করতে পারবেন বলে জানালেও তা ভাড়া কমাতে কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে সন্দিহান।
বাংলাদেশ কভার্ড ভ্যান, ট্রাক ও পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোতালেব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই দাম কমানোর বিন্দুমাত্র প্রভাব জনজীবনে পড়বে না। আগে বাড়িয়েছে অনেক টাকা, এখন কমালো মাত্র ৫ টাকা। তাহলে এর কী প্রভাব পড়বে। যদি প্রতি লিটার ডিজেল ১০০ টাকার মধ্যেও আনা যেত তাহলে একটা প্রভাব পড়ত।
“ধরুন জ্বালানির দাম বৃদ্ধির পর ফার্মগেইট গুলিস্তানের ভাড়া ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা করা হয়েছিল। এখান থেকে আবার ১০ টাকায় আসবে না। তবে আগে যেসব দূরত্বে জোর করে যাত্রীদের কাছ থেকে হিসাবের বাইরে ২/৩ টাকা বেশি নেওয়া হতো সেখান থেকে হয়তো কেউ কেউ সরে আসবে।”
পরিবহন খাতের আরেক নেতা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ আগের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভাড়া কমানোর কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে তিনি।
তিনি বলেন, “জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা করে কমানোর প্রভাব গণপরিবহনের জ্বালানি বাবদ খরচের ওপর পড়বে। ভাড়ার ক্ষেত্রেও হয়ত প্রভাব পড়তে পারে। এক্ষেত্রে বিআরটিএ ভাড়া সংক্রান্ত যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই আমরা মেনে নেব।
“তেলের দাম কমালে আমরা ভাড়া কমাব বলেছি। সেই কথার ওপরেই আমরা আছি। এখন এর প্রভাবে ভাড়া কতটা কমবে সেটা বিআরটিএ বলতে পারবে। আমরা বলতে পারব না।”
তবে ৫ টাকা দাম কমানোর সরকারি সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম।
তিনি বলেন, জনগণের উপকারের কথা বিবেচনা করে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এমনটা করা হয়েছে।
“এত বেশি বাড়িয়ে মাত্র পাঁচ টাকা কমিয়ে আনার অর্থ হচ্ছে বাড়ানোটাকে টেকসই করা; বিতর্কমুক্ত করা। বলা যেতে পারে এটা হাস্যকর প্রয়াস।“
এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, “জনগণের দিকে তাকিয়ে এটা কমানো হয়নি; তাহলে মানুষের উপকার হবে কী করে। তখন তো ১/২ টাকা ফকিরকে ভিক্ষা দেওয়া যেত, এখন তো ৫ টাকা ফকিরের ভিক্ষাও নেই।
“এরকম ফকিরের ভিক্ষার মত ৫ টাকা কমিয়ে জনজীবনে কী প্রতিকার হবে? এটা নিয়ে কথা বলাও নিজের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেওয়া।”
গত ৬ অগাস্ট সরকারের এক সিদ্ধান্তে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৮০ টাকা থেকে ৩৪ টাকা (৪২.৫ শতাংশ) বাড়িয়ে করা হয় প্রতি লিটার ১১৪ টাকা। পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে (৫১.১৬ শতাংশ) ৮৬ থেকে করা হয় ১৩০ টাকা এবং প্রতি লিটার অকটেনের দাম ৮৯ টাকা থেকে ৪৬ টাকা (৫১.৬৮ শতাংশ) বাড়িয়ে করা ১৩৫ টাকা হয়।
ডিজেলের অস্বাভাবিক এমন দাম বাড়ানোর পর বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে দূর পাল্লায় ৪০ পয়সা এবং নগরে ৩৫ পয়সা করে বাড়ানো হয়েছিল। দূর পাল্লায় আগের ভাড়া ১ টাকা ৮০ পয়সার জায়গায় ৪০ পয়সা বাড়িয়ে ২ টাকা ২০ পয়সা করা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে নতুন ভাড়া করা হয় ২ টাকা ৫০ পয়সা; আগে ভাড়া ছিল ২ টাকা ১৫ পয়সা।
সোমবার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা করে কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে এখন প্রতি লিটার ডিজেল-কেরোসিনের দাম ১০৯ টাকা, অকটেনের ১৩০ ও পেট্রোলের ১২৫ টাকা।
এ সিদ্ধান্তের পর গণপরিবহনের ভাড়া কমবে কি না জানতে চাইলে সুষ্পষ্ট উত্তর মেলেনি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরীর কাছ থেকে।
রাতে তিনি বলেন, “আমরা এখনও অর্ডারটা হাতে পাইনি। অর্ডার পেলে এ বিষয়ে বলতে পারব।”
সবশেষ ৬ অগাস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর চালের দর প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা করে। এছাড়া ডিম-মুরগিসহ সব ধরনের পণ্যমূল্যে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্তের প্রভাব পণ্য পরিবহনেও পড়লেও তাতে খুব বেশি হেরফের হবে বলে মনে করছেন না এ খাতের উদ্যোক্তারা।
পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির নেতা আব্দুল মোতালেব বলেন, পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নিয়মটা ভিন্ন। সরকার ওভাবে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় না। পণ্য পরিবহনের চাহিদা বেড়ে গেলে ট্রাক ভাড়া বেড়ে যায়, পণ্য পরিবহনের অর্ডার কমে গেলে ভাড়াও কমে যায়।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দর কমানোর কারণে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দূরত্বে আসা যাওয়ায় জ্বালানি বাবদ হয়ত ৫০০ টাকা রক্ষা হবে। কিন্তু সময়ে সময়ে ট্রাক-কভার্ডভ্যান ভাড়া ২/৩ হাজার টাকা উঠানামা করে। অথচ এই দূরত্বে জ্বালানির মূল্য বাড়ার ফলে খরচ তিন হাজার টাকা বেড়ে গিয়েছিল।
“তাহলে আগে জ্বালানি বাবদ খরচ ৭০০০ টাকা হলে এখন ৬৫০০ টাকা হবে। এটা আমাদের কাছে এমন কিছু না।“
খরচের বোঝায় যোগ হল বাড়তি বাস ভাড়া, বাড়ল ১৬-২২%
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক ধাক্কায় ৪২.৫%; অকটেন ও পেট্রোলে ৫১% বাড়ল
যুগান্তর ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি নামের একটি কোম্পানির স্বত্ত্বাধিকারী কাজী সরওয়ার হোসেন বলেন, এই ৫ টাকা কমানোতে খুব একটা স্বস্তি আসবে না। ঢাকা থেকে সাতক্ষীরার দূরত্বে একটি ট্রাক গেলে তেলের খরচ বাবদ হয়ত ৫০০ টাকা সাশ্রয় হতে পারে। কিন্তু বর্ডারে আমদানি রপ্তানি বেড়ে গেলে ট্রাক প্রতি ভাড়া ২/৩ হাজার টাকাও উঠানামা করে।
বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে এবং হিসাব নিকাশ শেষে লঞ্চ ভাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান।
মঙ্গলবার নৌপরিবহন মন্ত্রীর সঙ্গে আগে থেকে একটি বৈঠকের সূচি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে এটি উঠতে পারে।