জ্বালানি নিরাপত্তা: একটি বহুস্তর ভাবনা
বাংলাদেশের জ্বালানির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭২ সালের পর থেকে আমাদের মূল বা প্রধান জ্বালানি ছিল তেল। বাংলাদেশের সব উন্নয়ন প্রচেষ্টা ছিল জ্বালানি তেলভিত্তিক। শিল্প-কারখানা, বিদ্যুত্ উত্পাদন সবই নির্ভর করত জ্বালানি তেলের ওপর। ১৯৭৩ সালে আরব দেশগুলো জ্বালানি তেল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি আড়াই মার্কিন ডলার বেড়ে ১২-১৪ ডলারে উন্নীত হয়, যাকে বলা হয় ‘ফার্স্ট অ্যারাব অয়েল এমবার্গো শক’। আরব দেশগুলোর জ্বালানি তেল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে বিশ্বব্যাপী এর দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এ সময় উন্নত দেশগুলো বিকল্প জ্বালানি অনুসন্ধান শুরু করে। ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে বাংলাদেশের মোট আমদানি ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে ছিল খাদ্যপণ্য, এক-তৃতীয়াংশ ছিল জ্বালানি তেল এবং অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ অন্যান্য পণ্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আমাদের মোট আমদানি বাজেটের অধিকাংশই চলে যাচ্ছিল এটি আমদানিতে। এর আগ পর্যন্ত দেশে স্থানীয়ভাবে গ্যাসের কদর ছিল না। কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্যাস সম্পদ ব্যবহারে গুরুত্বারোপ করেনি। সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে আশির দশক পর্যন্ত ব্যাপক হারে গ্যাস ব্যবহার বাড়ে। ১৯৮৫ সালের পর আমাদের অর্থনীতি মোটামুটি গ্যাসনির্ভর হয়ে ওঠে, বিশেষ করে গত ১০ বছরে দেশে গ্যাস ব্যবহার অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়েছে। গ্যাসের এই ব্যাপক ব্যবহারের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে ক্যাপটিভভিত্তিক দ্রুত শিল্পায়ন, আবাসন শিল্পের বিকাশ ও সিএনজি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সময়ে যখন ‘জ্বালানি পরিবর্তন’ করা হয়, তখন থেকে একটি বড় ভুল করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভুল চিন্তাভাবনা কাজ করেছে— দেশের সম্পদ বিনামূল্যে বিতরণ করতে হবে। একটি সম্পদের যে অর্থনৈতিক মূল্য আছে এবং তা বিনামূল্যে বিতরণ করলে দ্রুততর সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যায় এবং অপচয় হয়, সেটা অনুধাবন করা হয়নি। অর্থাত্ যে জ্বালানি তেলকে গ্যাস দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হলো, সেই গ্যাসের দাম জ্বালানি তেলের সমপরিমাণ তো রাখা হলোই না বরং সে সময় জ্বালানি তেলের এক-পঞ্চমাংশ দামে গ্যাস দেয়া শুরু করা হয়। সেই ধারা এখনো চলছে। এ প্রবণতা থেকে এখনো বের হওয়া যায়নি। যদি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বিচার করা হয়, তাহলে ৯০ ডলারের সমপরিমাণ গ্যাসের দাম হওয়া উচিত ১৬ মার্কিন ডলার। অথচ বাংলাদেশে মাত্র ১ দশমিক ৭০ সেন্টে সেই গ্যাস বিক্রি করা হচ্ছে। এটিই গ্যাস সংকটের অন্যতম কারণ। কম দামের কারণে গ্যাসের অপচয় হচ্ছে এবং অপব্যবহারও হয়েছে।
২০০০ সালে যখন ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন হতো, তখন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এটি তখন প্রায় চার টিসিএফ মজুদের গ্যাসক্ষেত্র ছিল। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে তাত্ক্ষণিকভাবে গ্যাস উত্তোলন শুরু হলে অতিরিক্ত প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেত। ২০০০ সালেও এই অতিরিক্ত ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহারের সামর্থ্য আমাদের ছিল না। এ কারণে পেট্রোবাংলা ইউনিকলকে গ্যাস উত্তোলনের অনুমতি দেয়নি। যদিও ১৯৯৯ সালে এ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়। এজন্য ইউনিকল বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। বিনিয়োগকৃত এ অর্থ তারা তুলে আনতে চায় বলেই গ্যাস রফতানির প্রসঙ্গটি নিয়ে আসে, যদিও চুক্তিতে গ্যাস রফতানির শর্ত ছিল না। দেশে এ পর্যন্ত যত পলিসি হয়েছে, সেটা মূলত রিঅ্যাকটিভ পলিসি, প্রো-অ্যাকটিভ পলিসি নয়। স্থানীয়ভাবে গ্যাস বিক্রি করতে না পেরে তারা যখন রফতানির কথা বলল, তখন নানা ধরনের বিতর্ক শুরু হয়। এক পক্ষ বলতে থাকল, গ্যাস দেশের সম্পদ। এটা কোনোভাবেই রফতানি করতে দেয়া উচিত নয়। অন্য পক্ষ দাবি করল, গ্যাস রফতানি করতে দেয়া উচিত। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার থেকে গ্যাস ব্যবহার বাড়ানোর জন্য ব্যাপক হারে সংযোগ দেয়া শুরু হয়। এর ফলে ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস ব্যবহার শুরু হলো। সিএনজি স্টেশনে গ্যাস ব্যবহার শুরু হলো। শিল্প-কারখানা সর্বত্রই যে যেভাবে চাইল গ্যাসের সংযোগ দেয়া হলো। এটা করা হলো মূলত গ্যাস রফতানি ঠেকাতে স্থানীয়ভাবে চাহিদা বৃদ্ধির জন্য। এতে গ্যাসের অপচয় বেড়ে গেল। ২০০৪ সালে পেট্রোবাংলা ইউনিকলকে নির্দেশ দেয় বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র ডেভেলপ করতে। ২০০৭ সালের মার্চে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্পাদন শুরু হয়। উত্পাদনের শুরুতেই তারা ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। তার পরও দেখা গেল, ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে। কারণ আগের পাঁচ বছরে গ্যাস ব্যবহার বিবেচনাহীনভাবে বাড়িয়ে দেয়ায় অতিরিক্ত ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহের পরও চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ২০০৮ সালে দেশে গ্যাস সরবরাহ ছিল ১ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট, তখনো গ্যাসের সরবরাহজনিত ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।
১৯৯৬ সালে জাতীয় জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করা হয়। সেই জ্বালানি নীতিতে গ্যাসভিত্তিক জ্বালানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে সম্ভাব্য জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকির ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছিল। ২০০১ সালে দুটো জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। ২০০৬ সালে ‘ম্যাকেঞ্জি উড’ পেট্রোবাংলার একটি স্টাডি করেছে। ২০০১ সালে জাতীয় কমিটি তাদের রিপোর্টে বলেছে, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে কোনো গ্যাস রফতানি করা না হলেও ২০১০ সালে দেশে এর ঘাটতি দেখা দেবে। কারণ ১৯৯৯ সাল থেকে দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ হয়নি। পলিসিতে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে আইওসি নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। বাপেক্সও চুপচাপ বসে থাকল। পরবর্তী সময়ে বাপেক্স চার-পাঁচটি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি।
১৯৯৬ সালে অর্থাত্ আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে জাতীয় জ্বালানি নীতিতে বলা হয়েছিল, মনোফুয়েল-নির্ভরতা বাংলাদেশের জন্য আগামীতে জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। তখন সুনির্দিষ্টভাবে পরামর্শ দেয়া হয়, দেশের উত্তর-পশ্চিমে যে কয়লা আছে তা ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়ার। কয়লা উত্তোলন এবং নিজস্ব কয়লা থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও সেই পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। তাত্ক্ষণিকভাবে যেহেতু গ্যাসের অভাব হয়নি, তাই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। এখানে দূরদর্শিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারকদের পেশাগত দক্ষতা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কারণ তারা এ ব্যাপারে পেশাগতভাবে যারা দক্ষ, তাদের পরামর্শ শোনেননি। রাজনীতিবিদরা মনে করেছেন, ভালোভাবেই তো চলছে। তারা সম্ভাব্য সংকটের বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে পারেননি, যদিও রিপোর্টে এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল। বর্তমানে যে জ্বালানি সংকট চলছে, তাতে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের অভাব রয়েছে। দেশে যেসব বিদ্যুত্ প্রকল্প স্থাপিত হয়েছে, সেগুলো প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনে সক্ষম। এর মধ্যে ৬ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনক্ষম প্রকল্প রয়েছে, যা গ্যাসভিত্তিক। বাংলাদেশের মূল সমস্যা হচ্ছে, প্রাথমিক জ্বালানি ঘাটতি। বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করেও প্রাথমিক জ্বালানি না থাকায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যাচ্ছে না। সরকার ২০১০ সালে জাইকার সহায়তায় জ্বালানি মিশ্রণ কী হবে তার একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এ পরিকল্পনা মোতাবেক ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ অর্থাত্ ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে কয়লাভিত্তিক। এর মধ্যে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে আমদানিকৃত কয়লা থেকে। অবশিষ্ট ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে স্থানীয়ভাবে আহরিত কয়লা থেকে। আরো ২৫ শতাংশ বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে গ্যাস থেকে। অর্থাত্ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত্ প্রকল্প থেকে প্রায় নয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু এ মুহূর্তে চার হাজার মেগাওয়াটের বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদন সম্ভব না। কারণ দেশে গ্যাস সংকট চলছে। এ অবস্থায় অবশিষ্ট পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ কীভাবে গ্যাস থেকে উত্পাদন হবে সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। মনে করা হচ্ছে, আগামীতে দেশে যে গ্যাস আবিষ্কৃত হবে সেখান থেকে এই বর্ধিত চাহিদার জোগান দেয়া যাবে, কিন্তু সেটা আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। এর একটি সমাধান হতে পারে আমদানিকৃত এলএনজি, কিন্তু সেখানেও উচ্চমূল্যের বিষয় আছে। বর্তমানে জ্বালানি তেল ব্যবহার করে যে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হচ্ছে তা বন্ধ করে দিয়ে সেখানে এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেতে পারে, যদিও সেই জ্বালানি মিশ্রণে ১০ ভাগ তেলভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের কথা বলা আছে। অবশিষ্ট বিদ্যুত্ নিউক্লিয়ার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা যায়।
অর্থাত্ ভবিষ্যতে বিদ্যুত্ চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ শতাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র, ২৫ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ বিদ্যুত্ নিউক্লিয়ার ও অন্যান্য সূত্র থেকে আহরণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বলা যায়, এ জ্বালানি মিশ্রণটা সঠিক আছে। জ্বালানি নিরাপত্তার ঝুঁকি, মূল্যঝুঁকি এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই জাইকা এ জ্বালানি মিশ্রণ তৈরি করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নিজস্ব কয়লা সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার এখনো উদ্যোগ নেয়নি। যদি বিদেশের ওপর নির্ভর করে জ্বালানি নিরাপত্তা গড়ে তুলতে হয়, তাহলে ঝুঁকি থেকেই যায়। মোট জ্বালানি উত্পাদনের ২৫-৩০ শতাংশের জন্য বিদেশী সূত্রের ওপর নির্ভর করা যেতে পারে, কিন্তু বেশির ভাগ জ্বালানি নিজস্ব উত্স থেকে আহরণের ব্যবস্থা করতে হবে। যদি জ্বালানির বড় অংশের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হয়, তাহলে দুই ধরনের ঝুঁকি বহন করতে হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সরবরাহজনিত ঝুঁকি। আর অন্যটি দামবৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি। সরকার জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে যেসব বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করছে, সেগুলো পরিকল্পনার মধ্যেই আছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে কয়লা আহরণের পরিবর্তে অন্যভাবে যেটা করা হচ্ছে, তাতে জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে এবং দাম অনেক বাড়বে। কারণ দেশী কয়লায় ৪-৫ টাকায় যে পরিমাণ বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যেতে পারে, সেই একই পরিমাণ বিদ্যুত্ আমদানিকৃত কয়লা ব্যবহার করে উত্পাদন করা হলে খরচ হবে ৮ টাকা। বিদেশী আমদানিকৃত প্রাথমিক জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হলে এর উত্পাদন খরচ হবে অনেক বেশি। এই উচ্চমূল্য ও স্বল্পমূল্যের মধ্যে যদি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে দেশী কয়লা ব্যবহার করতেই হবে। এটা হচ্ছে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এক নম্বর কাজ। দুই নম্বর কাজ হচ্ছে, ব্যাপকভিত্তিক গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু।
স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম হাইকোর্টে রিট করে বন্ধ রাখা হয়েছে। যদিও শোনা যাচ্ছে, এই রিট ভ্যাকেট করা হয়েছে। তাহলে স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান চালানোর অনুমতি দেয়া যেতে পারে। সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল তা মীমাংসা হয়ে যাওয়ার ফলে এ সুযোগ আরো বেড়েছে। কিন্তু সমুদ্রে গ্যাস ও অন্যান্য সম্পদ সম্পর্কে কোনো তথ্য-উপাত্ত আমাদের কাছে না থাকায় বিদেশী কোম্পানিগুলো এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। যারা আগ্রহ নিয়ে আসছে, তারা উচ্চমূল্য দাবি করছে। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ এলাকায় ব্যাপকভিত্তিক সার্ভে হওয়া দরকার। সার্ভে হলে জানা যাবে, সেখানে সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা। সমুদ্রের নিচে যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে এক ধরনের চুক্তি করতে হবে। আর যেখানে সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা কম, সেখানে অন্য ধরনের চুক্তি করতে হবে। যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেখানে চুক্তির শর্তাবলি বাংলাদেশের অনুকূলে থাকবে। আর যেখানে সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা কম, সেখানে চুক্তির শর্ত বাংলাদেশের প্রতিকূলে থাকবে। এটাই হচ্ছে ঝুঁকি পুরস্কারের ভারসাম্য। ঝুঁকি ও পুরস্কারের মধ্যে যে সমন্বয় তার মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের স্থলভাগে আর বড় ধরনের গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাহলে স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান চালানোর জন্য বিদেশী কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেয়া যায়। বাপেক্স বা পেট্রোবাংলা যদি কিছু স্থানে অনুসন্ধান চালাতে চায়, তাও করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনছে। বিদেশী কোম্পানিগুলো অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ করে যাচ্ছে। এর গড় দাম পড়ছে দেড় মার্কিন ডলারের মতো। এর বিকল্প কী আছে? এর বিকল্প হতে পারে এলএনজি আমদানি করা। বর্তমানে এলএনজির আন্তর্জাতিক দাম হচ্ছে ১৩-১৪ মার্কিন ডলার। এটা ১৮ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। বিদেশী কোম্পানিকে কিছুটা বেশি দাম দিয়ে যদি তাদের কাছ থেকে গ্যাস কিনি, তাহলেও সেটা এলএনজির তুলনায় অনেক কম হবে। বাপেক্সের নিজস্ব জায়গা বাদে স্থলভাগের সবটুকু বিদেশী কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেয়া উচিত। কারণ তারা যদি অনুসন্ধান করে কোনো কিছু না পায় তাহলে বাংলাদেশের বিনিয়োগ ঝুঁকি বহন করতে হবে না। বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে পিএসসি স্বাক্ষর করা যেতে পারে। বিশ্বের ১৬৪টি দেশে পিএসসি আছে। দেশের কিছু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি বলছেন, পিএসসি খারাপ, পিএসসি দেশের স্বার্থ পরিপন্থী। যদি তাই হবে তাহলে বিশ্বের এতগুলো দেশে পিএসসি আছে কেন? যেসব দেশে অর্থের অভাব রয়েছে, দক্ষ জনশক্তির সমস্যা আছে, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে, সেসব দেশ পিএসসির মাধ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করে থাকে। যেহেতু আমরা নিজেরা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করতে পারছি না, তাই বিদেশী কোম্পানির সহায়তা নেয়াই সঠিক। বাপেক্স বা এ ধরনের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতার অভাব রয়েছে। সুতরাং বাপেক্সকে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে রকম ম্যানেজমেন্ট সমস্যা আছে, তাতে ইচ্ছা করলেই বাপেক্সকে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যাবে না। করপোরেট কালচার এখনো বাংলাদেশে সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। করপোরেট কালচার গড়ে তুলতে হলে নতুন করে শুরু করতে হবে। আর বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, দক্ষ লোকবলের অভাব। দেশে প্রচুর মানুষ আছে, কিন্তু দক্ষ লোকবলের অভাব প্রকট। দক্ষ লোকবলের অভাব যে শুধু জ্বালানি বা বিদ্যুত্ খাতে তা নয়, সব ক্ষেত্রেই এর অভাব রয়েছে। এমনকি বিদেশে যে জনশক্তি পাঠানো হয়, সেখানেও দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। ফলে অন্যান্য দেশ কমসংখ্যক জনশক্তি বিদেশে পাঠিয়েও বাংলাদেশের তুলনায় বেশি অর্থ আয় করছে। বাংলাদেশের জ্বালানি সেক্টরে বর্তমানে যে কার্যক্রম চলছে, সেখানে অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে, যদিও জ্বালানি মিশ্রণের পরিকল্পনাটি সঠিক বলেই মনে করি। তবে দেশী কয়লার ব্যবহার ও গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। এটা দূর করতে হবে। নিজস্ব কয়লা উত্তোলনের ব্যবস্থা না করা হলে ভবিষ্যতে আমাদের বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা