জ্বালানি, পরিবেশ ও স্বক্ষমতা
অমর্ত্য সেন:
জ্বালানিশক্তি নিয়ে ভাবনাচিন্তার সাম্প্রতিক মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়েছে কার্বন নিঃসরণ কীভাবে কমানো যায় তার ওপর। ফলে জ্বালানির ব্যবহার কেমন করে সীমিত করা যায়, সে পথ খোঁজা হচ্ছে। বরং এমন চিন্তা করা হচ্ছে না, যেখানে দারিদ্র্যকে পরাজিত করতে জ্বালানির ব্যবহার একটি মৌলিক বিষয়। ফলে পরিবেশের সমস্যাকে বুঝতে সর্বাঙ্গীণ উপলব্ধির প্রয়োজন। পরিবেশের বৈশ্বিক আলোচনায় দরিদ্র দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান জ্বালানিশক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা কদাচিৎ স্বীকার করা হয়। যেমন ভারতে সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশের ঘরে কোনো ধরনের বিদ্যুৎ সংযোগই নেই।
পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদন যদি সহজতর হয় (বিদ্যুতের ব্যবহারও কুশলতার সঙ্গেই করা হয়), তবে সেটি কেবল পরিবেশবিষয়ক পরিকল্পনাতেই কাজে আসবে না; বরং তা বহুসংখ্যক বঞ্চিত মানুষকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত জীবন যাপন করতে সক্ষম করে তুলবে।
আমি দরিদ্র দেশগুলোর যে বাস্তব অবস্থার কথা বলব, সেটি শুনলে খুব নগণ্য মনে হবে, কিন্তু বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে এখনই স্বীকৃতি দেয়া জরুরি। পৃথিবীর অনেক অঞ্চল, যেখানকার জনগোষ্ঠী ব্যপক মাত্রায় দরিদ্র, সেসব অঞ্চল প্রাকৃতিকভাবেই বেশ সূর্যালোকিত। ফলে এই বিপুল সৌরশক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগানোর সুযোগটির প্রতি কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অবশ্য সূর্যের আলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করতে হলে বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত সীমাবদ্ধতার সমাধান করতে হবে।
দুনিয়ার অনেক দরিদ্র অঞ্চলে ব্যাপক মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে স্ব-ক্ষমতার সম্ভাবনা রয়েছে, যদি পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ, শক্তি সংরক্ষণ ভাণ্ডার ও সৌরশক্তি ব্যবহারের ব্যবস্থা তৈরি করা যায়। এ দৃষ্টিভঙ্গিটি কিছু দেশকে বেশ সুবিধা দিতে পারে বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশের সাব-সাহারা অঞ্চলের অনেক দেশকে যাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ভাণ্ডার সীমিত বলে আমরা জানি।
জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সৃষ্ট বৈশ্বিক দূষণের বিপদ সম্পর্কে জনমত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পারমাণবিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের আকর্ষণ বেশ বেড়েছে। বিশেষত, বিজ্ঞানী সমাজ পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের প্ররোচনায় পা ডুবিয়েছে কিন্তু বৈশ্বিক নীতিনির্ধারকদের ওপর তাদের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। যেমন বিশ্বব্যাংক সৌরশক্তি, পারমাণবিক শক্তি ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তি একসঙ্গে মিশিয়ে সারা দুনিয়ার ‘ক্লিন এনার্জি’ বা ‘দূষণহীন শক্তি’র তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেছে: ‘দূষণহীন শক্তি হলো নন-কার্বোহাইড্রেট শক্তি যেটি উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে না। দূষণহীন শক্তির মধ্যে জলবিদ্যুৎ শক্তি, পারমাণবিক শক্তি, জিওথার্মাল শক্তি ও সৌরশক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
উচ্চ হারে জীবাশ্ম জ্বালানির চলমান ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনে যতটা বিরূপ প্রভাব ফেলে, তার তুলনায় পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার ভালো। কারণ এতে জলবায়ুর ওপর সে রকম বিরূপ প্রভাব ফেলে না। তা সত্ত্বেও বিদ্যুতের ব্যবহার ও উৎপাদনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো শুধু জলবায়ু পরিবর্তনেই প্রভাব রাখে না। পারমাণবিক শক্তির পরিবেশের ওপর বহিঃস্থ প্রভাব ভিন্ন ধরনের— যেটির প্রভাব খুবই মারাত্মকভাবে নেতিবাচক। এই ধ্বংসাত্মক প্রভাব ও তার ক্ষতিপূরণ কিংবা জরিমানা হয়, সেটি পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের ব্যয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ফলে পারমাণবিক উৎস থেকে বিদ্যুতের বাজারমূূল্যে এর কোনো প্রতিফলন নেই। সুতরাং পারমাণবিক বিদ্যুতের বাজারমূূল্যের কম খরচের বিষয়টি পরিপূর্ণ সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে, উল্লিখিত ক্ষতি হিসাবের মধ্যে ধরলে খরচ অনেক।
পরিবেশ রক্ষা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ শক্তির উৎসগুলোর মূল্যায়ন দাবি করে মূল্য নিরূপণের জন্য ব্যাপক ও গভীর হিসাবরক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োজন। একটি যথাযথ হিসাবরক্ষণ পদ্ধতির জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনে বহিঃস্থ প্রভাবগুলো কীভাবে হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, তার জন্য নতুন গবেষণা পদ্ধতির আবিষ্কার। যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশকিছু অনিশ্চয়তায় ভরা একটি প্রক্রিয়া, ফলে অতীতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা বা সমস্যাগুলো সংঘটনের হারের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনার সম্ভাব্যতা হিসাব করা যাবে না। অনিশ্চয়তার চ্যালেঞ্জ না নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক মূল্যায়ন এখন সম্ভব নয়।
পারমাণবিক শক্তির বিদ্যুৎ উৎপাদনে কমপক্ষে পাঁচ প্রকারের বিভিন্ন বহিঃস্থ (এক্সটার্নালিটিজ) ব্যয় সৃষ্টি হয়, যেগুলোর সামাজিক ক্ষতিকর প্রভাব বেশ বড় অংকের। সেগুলো হলো, সম্ভাব্য পারমাণবিক দুর্ঘটনার ফলে ব্যাপক মাত্রার ক্ষতি (চেরনোবিল ও ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনা), সন্ত্রাসী হামলা ও নাশকতাজনিত ঝুঁকি (যেমন ভারতের সমূহ ঝুঁকি রয়েছে), পারমাণবিক স্থাপনায় সম্ভাব্য চুরি (সবখানেই এর সম্ভাবনা রয়েছে, তবে কম সুরক্ষিত স্থানগুলোয় এর সম্ভাবনা বেশি), পারমাণবিক বর্জ্য নিরাপদে স্থানান্তর করা (যতই সময় গড়াবে ততই এ বর্জ্যের পরিমাণ বাড়বে, যদি পৃথিবীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তির ওপর বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে), আর যদি একবার যুদ্ধ লেগে যায় একটি সাধারণ মানের যুদ্ধ লাগলেও সেখানে গড়পড়তা অস্ত্র ব্যবহার করা হলেও এবং শেষ পর্যন্ত কোনো পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলা হলে তার তেজস্ক্রিয়তা মারাত্মক ছড়িয়ে পড়বে। এমনকি এ যুদ্ধ স্থানীয়ভাবে ছোট আকারে ও অল্প পরিসরে হলেও তার ক্ষতি হবে বিপুল। উল্লিখিত বহিরাগত (এক্সটার্নালিটিজ) কারণগুলোর প্রতিটির মানুষের জীবন ও আমাদের চারপাশের বাস্তুসংস্থানের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি এসব বিপদের প্রতিটির খুব ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকলেও প্রতিটি নতুন পারমাণবিক স্থাপনার সঙ্গে উল্লিখিত পাঁচটি বিপদ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে সার্বিকভাবে বেশ বড়সড় বিপদের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। সম্ভাব্য ক্ষতির প্রাক্কলিত হিসাব বিপুল পরিমাণ হবে (ক্ষতির মাত্রা ভয়াবহ থেকে মহাবিপর্যয়ের অবস্থায় পৌঁছবে)। গতানুগতিক অর্থেই পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন বেশ ব্যয়সাপেক্ষ এবং তার সঙ্গে যদি উল্লিখিত প্রতিমূল্য (ডিসভ্যালু) বা অ-উপযোগিতাগুলো (ডিসইউটিলিটি) বহিরাগত প্রভাবক হিসেবে বাড়তি ব্যয় যোগ করে, তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মোট ব্যয় বিপুল আকার হবে।
তবে নিকট ভবিষ্যতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে প্রতিস্থাপিত করবে তার সম্ভাবনা খুব কম। যদিও দীর্ঘমেয়াদে এ অবস্থা পাল্টে যেতে পারে। কিন্তু পারমাণবিক দুর্ঘটনা, এর স্থাপনায় সন্ত্রাসী হামলা, নাশকতা কিংবা চুরি হওয়ার সম্ভাবনা আগে থেকেই ছিল বিপুল। এমনকি পারমাণবিক শক্তি সারা পৃথিবীতে কয়লা, তেল ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে প্রতিস্থাপিত করার নিকটবর্তী হওয়ার আগে থেকেই এসব বিপদের সম্ভাবনা রয়ে গেছে। অধিকন্তু, পারমাণবিক শক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের নকশায় ঝুঁকি থেকে বাঁচার অনেক সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখা হলেও এর খরচ হবে বিপুল এমনকি গতানুগতিক হিসাবেও।
বেশ ছোট পরিসরে হলেও কয়েক বছর আগে বিকল্প পদ্ধতির বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে, যেসব উৎস সম্পর্কে বর্তমানে বেশ গুরুত্ব দিয়ে ভাবনা চলছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তির উৎসগুলো হলো সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং জলস্রোত/জলতরঙ্গের শক্তি। সাম্প্রতিক কালে নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তিগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়, বিশেষত সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় দ্রুত কমে আসছে এটি আশাতীতভাবে বেশ দ্রুতগতিতে কমছে। চীনে প্রযুক্তির উদ্ভাবন সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের দাম কমাতে সাহায্য করলেও সৌর প্যানেল উৎপাদন শিল্পে সরকারি ভর্তুকিও এক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। চীনের এ ধরনের পদক্ষেপ দেশের বাইরেও সৌরশক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে বিশেষত ক্রমহ্রাসমান ব্যয় এবং তার বিপরীতে সুফলের দিকটি বিবেচনায় নেয়া হলে। উদাহরণস্বরূপ, অতি সাম্প্রতিক কালে ভারতে এর ব্যবহার বেড়েছে। কারণ চীনা সৌর প্যানেলের সরঞ্জাম আমদানিতে খরচ বেশ কমে গেছে। কম দাম ও উচ্চ ভর্তুকির চীনা সৌর প্যানেলকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাদের বাজারে ঢুকতে দিতে চায় না, তার প্রধান কারণ হলো, তাদের (যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ) নিজ নিজ দেশীয় সৌর প্যানেল শিল্পের স্বার্থ রক্ষা। সস্তা দামের চীনা সৌর প্যানেলগুলোর টেকসই হওয়ার শক্তি ও গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিতভাবেই প্রশ্ন উঠবে; কিন্তু তুলনা করতে হলে সুরক্ষার পক্ষপাত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
(অমর্ত্য সেন: অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী)
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর আহমেদ জাভেদ, দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
সূত্র: দৈনিক বণিকবার্তা