ঢাকায় নিম্ন আয়ের বসতির ৭০ ভাগ মানুষই জলবায়ু উদ্বাস্তু
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বাড়ছে উদ্বাস্তুর সংখ্যা। ঢাকায় নিম্ন আয়ের বসতিদের এলাকায় প্রায় ৭০ শতাংশই জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে উদ্বাস্তু হয়েছে।
জাতিসংঘের অভিবাসন-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা—আইএমও-এর এক গবেষণায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা ও নদীভাঙন বাড়ছে। বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা। সাগরের লবণাক্তও বেড়ে গিয়ে পরিবেশকে বসবাসের অনুপযোগী করছে তুলছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এমনই এক মানুষ মাহফুজুর রহমান। বাড়ি সাতক্ষীরার মুন্সীগঞ্জ উপজেলার উত্তর কদমতলায়। আগে কৃষি কাজ করে জীবন নির্বাহ করলেও এখন আর তার কোনও কাজ থাকে না। বাধ্য হয়েই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আসতে হয় শহরে। বছরের বেশিরভাগ সময় আশেপাশের জমি সব পানিতে ডুবে থাকে।
শুধু মাহফুজুর রহমান নন, তার মতো অনেকেই আজ এই পরিবর্তনের শিকার। আর এভাবেই বেড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা।
ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার-এর হিসাব অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত ছয় বছরে বাংলাদেশের ৫৭ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন।
লবণপানি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলকে ধীরে ধীরে গ্রাস করায় সেখানকার মানুষ শুধু কাজ হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে। খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা, বাগেরহাটের মংলা ও শরণখোলা, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলাসহ সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এক জনপদ। এছাড়া একই উপজেলার পদ্মপুকুর ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরও জলাবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০০৯ সালে আইলার পর পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে টিকতে না পেরে গাবুরার আট হাজার পরিবারের মধ্যে তিন হাজারই আবাস্থল ছেড়ে চলে গেছে।
এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ-পরিচালিত গবেষণায় পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে অভিবাসী হওয়া প্রায় দেড় হাজার পরিবারকে শনাক্ত করা হয়। পরিবারগুলোর সদস্যরা জানান, পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে তারা স্থানান্তরিত হয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত চার লাখ লোক ঢাকায় চলে আসে। দিনের হিসাব করলে প্রতিদিন কম করে হলেও দুই হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকায় আসে আশ্রয়ের সন্ধানে। যাদের ঠাঁই হয় বস্তিতে। তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই জলবায়ু উদ্বাস্তু।
প্রতিবছর বাংলাদেশে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ৮ মিলিমিটার করে বাড়ছে। যা বিশ্বের গড় বৃদ্ধির দ্বিগুণ। ২০৮০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে পানির উচ্চতা ২ ফুট বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশের ৪০ ভাগ এলাকা লবণ পানিতে তলিয়ে যাবে। আর এই ৪০ ভাগ এলাকায় প্রায় ৫ কোটি মানুষের বসবাস। এর ফলে ফসলি জমি নষ্ট হবে, কৃষক-জেলে তাদের পেশা হারাবে। তারা হারাবে তাদের আশ্রয় বা আবাস।
নদী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘বাংলাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ তিনটি কারণে দেশান্তরী হচ্ছেন। প্রথমত, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে লবণাক্ততা বাড়ছে; দ্বিতীয়ত, আইলা-সিডরের কারণেও লবণাক্ততা বাড়ছে; তৃতীয়ত, উজান থেকে মিঠা পানি না আসার কারণেও লবণাক্ততা বাড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘শীতকালে ওইসব এলাকার পানির লবণাক্ততা সমুদ্রের পানির মতোই হয়ে যায়। বর্ষাকালে কিছুটা কমলেও তা গ্রহণযোগ্য মাত্রার তুলনায় অনেক বেশি থাকে। ফলে তীব্র খাবার পানির সংকট তৈরি হচ্ছে। একইসঙ্গে কৃষি কাজও করা যাচ্ছে না। ফলে জীবিকা হারিয়েছেন অনেকে। জীবিকার সন্ধানে বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম এমনকি ঢাকাও আসছে অনেকে। সীমান্তা পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশেও যাচ্ছেন।’
অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাঁধগুলোর উচ্চতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মিঠা পানির প্রবাহ বাড়াতে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প প্রয়োজন হবে। তবে এসব করার পরও এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ নেই।’ এটি অব্যাহতভাবে ঘটতেই থাকবে বলে তিনি অভিমত দেন।