মূল কারণ অজানা: লো ভোল্টেজ দায়ি
ছয়দিনেও বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের নিদিস্ট কারণ জানা গেল না। তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে লো-ভোল্টেজের কারণে বিপর্যয় হয়েছিল বলে জানানো হলেও তার উৎপত্তি কোথায় তা জানা যায়নি। অথচ বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের প্রথমদিন লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল পশ্চিমাঞ্চল গ্রিড লাইনে সমস্যার কারণে বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়েছে।
বৃহস্পতিবার কমিটি তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন মন্ত্রনালয়ে জমা দিয়েছে।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লো-ভোল্টেজের জন্য জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড বিপর্যয় হয়েছিল। কিন্তু কোথা থেকে এবং কেন এর উৎপত্তি তা এখনও জানা যায়নি। দেশের কোন এক স্থান থেকে এর উৎপত্তি হতে পারে। তবে পশ্চিমাঞ্চল গ্রিড থেকে হয়নি। সেখানে কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি। এছাড়া ভারতের কোন সমস্যার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরী হয়নি।
গতকাল বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের সভাকক্ষে এই প্রতিবেদন নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এসময় কমিটির আহবায়ক অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. আহমেদ কায়কাউস ও সদস্য সচিব পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেনসহ অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।তদন্ত কমিটি চ’ড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আরও ১০ কার্য দিবস সময় নিয়েছে।
সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে জানানো হয়, ধারণা করা হয়েছিল ভেড়ামারা আন্তঃসংযোগ বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন থেকেই এই সমস্যার উদ্ভব। এজন্য প্রথমে ভেড়ামারা পরিদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি। এরপর আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন করা হয়েছে। সেখানেও কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি। ভেড়ামারা সাবস্টেশন আধুনিক হওয়াতে সেখানে সব তথ্য সহজে পাওয়া গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে যা আধুনিক না। সে জন্য সেখানের তথ্য পেতে দেরি হচ্ছে। সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য উপাত্ত নিয়ে যাচাই করে চ’ড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে। বলা হয়, বিদ্যুৎ প্রবাহ কম বা বেশি হলে দ্রুত এই প্রবাহ কমাতে বা বাড়াতে হয়। এবিষয়ে কারও কোন গাফিলতি আছে কিনা জানতে চাইলে কিছু বলা হয়নি।
কোন সমস্যা দেখা দিলে সয়ংক্রিয়ভাবে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পদ্ধতি থাকতেও এমন কেন হল জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সয়ংক্রিয় পদ্ধতি যথাযথ কাজ করেছে। এজন্য উৎপাদনে থাকা কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র সমস্যায় পড়েনি। সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এরফলে দ্রুত আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা সঞ্চালন করা সম্ভব হয়েছে।
সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে ভারতের একটি গ্রিড বিকল হয়ে যায়। ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসতে না পারার কারনে সেখানে লোড বেড়ে যায়। এতে সেখানে যে দুটো গ্রিড লাইন আছে তার একটা বিকল হয়ে পড়ে।
ভেড়ামার আন্তঃদেশীয় সাবস্টেশন, আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ন্যাশনাল লোড ডেসপাচ সেন্টার (এনএলডিসি) এবং হরিপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রর তথ্য পর্যালোচনা করে এই প্রাথমিক প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্রর তথ্য পর্যালোচনা করে পরে বিস্তারিত জানানো হবে বলে জানানো হয়।
১লা নভেম্বর ১১টা ২৮ মিনিটে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় হয়েছিল। সে দিনই বিকাল ৪টায় এনএলডিসিতে লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল, পশ্চিমাঞ্চল গ্রিডে সমস্যা দেখা দেয়ার কারণে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় হয়েছে। সে দিন লিখিত বক্তব্য পাঠ করে শোনান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আলবেরুনী। সে সময় প্রতিমন্ত্রীসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু গতকাল একথা সম্পূর্ন অস্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আগের দিন ধারণার উপর নির্ভর করে সেই তথ্য দেয়া হয়েছিল। এখন তদন্ত করে দেখে বলা হচ্ছে।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত কমিটির প্রধান বিদ্যুত বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আহমেদ কাইকাওয়াস বলেন, ধারনা দেয়া হয়েছিল পশ্চিমাঞ্চল গ্রিডের কারণে এই বিপর্যয় হয়েছে। এজন্য আগে পশ্চিমাঞ্চল গ্রিডে ত্রুটি খুঁজতে যাওয়া হয়েছিল। এইসব স্থানে কোন ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায়নি যাতে এ ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। তিনি বলেন, সেখানে সব তথ্য সংরক্ষিত আছে। সে তথ্য পরিবর্তন করার কোন সুযোগ নেই। দেশের অনেক বিদ্যুত কেন্দ্র আছে পুরানো। সেসব কেন্দ্র থেকে তথ্য পেতে দেরি হচ্ছে।
তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আমাদের দেশের মধ্যে আগে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়েছে। এর পর ভারতের দুটি লাইনের মধ্যে একটি বিকল হয়। ফলে ভারতের কারণে এই সমস্যা নয় তা নিশ্চিত হওয়া গেছে বরং আমাদের বিপর্যয়ের কারণে ভারতে সমস্যা হয়েছে।
বিদ্যুত বিপর্যয়ের প্রথম দিন থেকেই বলা হয় আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি বা লোভোল্টেজের কারণে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তবে কোথায় এই সমস্যা তা কেউ বলতে পারেনি। রবিবারও বলা হয়েছিল পশ্চিমাঞ্চল গ্রিডে কোন ত্রুটির কারণে এই বিপর্যয় হয়েছে। তদন্ত কমিটি তিন দিন তদন্ত করার পরও লো ভোল্টেজের কথাই বলছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমরা ঘটনার গভীরে প্রবেশ করতে চাচ্ছি। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করা যায়। আমাদের সঞ্চালন ব্যবস্থায় কোন ত্রুটির কারণেই বিপর্যয় হয়েছে এ বিষয়ে নিশ্চিত। আমাদের সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়নের চিন্তা করছি। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থানের বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করছি। এরমধ্যে বিদ্যুত কেন্দ্রর উৎপাদন, তখন ফ্রিকোয়েন্সিতে বিদ্যুত দেয়া হচ্ছিল ব্যাকআপ রিলে কাজ করছিলো কি না। এসব তথ্য বিশ্লেষন করা হচ্ছে। ছয় দিনেও ব্যর্থতার দায় তিনি নেবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর দেননি।
গত শনিবার বিদ্যুত বিপর্যয়ে সারাদেশ অন্ধকারে তলিয়ে যায়। ওই দিন বেলা ১১টা ২৮ মিনিটে এবং বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে দুই দফা সঞ্চালন লাইনে বিপর্যয় (ট্রিপ করে) দেখা দেয়। এতে সরাদেশ বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম এবং সিলেট এলাকায় এবং রাতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিদ্যুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। পরের ভোর ৩টা থেকে ৪টার দিকে সকল জেলায় বিদ্যুৎ পৌছানো সম্ভব হয়।
সেদিনই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণ বের করতে দুটো কমিটি করা হয়। দুই কমিটিকেই তিন দিনের সময় দেয়া হযেছিল।
সাংবাদিক সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে কমিটির সদস্য বিপিডিবি’র সদস্য (উৎপাদন) শাহিনুল ইসলাম খান, পিজিসিবি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম-আল-বেরুনী, ইজিসিবি’র ব্যবস্থ্পানা পরিচালক মোস্তফা কামাল, ডিপিডিসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) নজরুল হাসান, আরইবি’র সদস্য (প্রকৌশল) এসকে নুরুল আবসার ও বিপিডিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান খিজীর খান উপস্থিত ছিলেন।