তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে অনিয়ম-দুর্নীতি: টিআইবি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে টিআইবি।
বরিশাল ও বাঁশখালি কয়লাভিত্তিক এবং মাতারবাড়ী এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ।
বুধবার অনলাইনে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে প্রতিবেদন প্রকাশ করে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রভাবশালী মহলকে অনৈতিক সুবিধা দিতে প্রকল্প অনুমোদন, ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম, বিদ্যুতের বাড়তি দাম নির্ধারণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতিযোগিতাভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার না করে বিশেষ বিধান এর আওতায় চুক্তি করা হয়েছে।
জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের হয়রানি করা হয়েছে। করা হয়েছে মানবাধিকার লংঘন।
প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও আমলাদের স্বার্থ
বিবেচনায় এসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
‘বাংলাদেশে কয়লা ও এলএনজি বিদ্যুৎ প্রকল্প: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
এসময় জ্বালানি খাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে সাত দফা সুপারিশ করে সংস্থাটি।
সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয়, গত দশকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হলেও, এখাতে উদ্বেগজনকভাবে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। বিশেষ করে, দাতা ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী নির্ভরশীল পরিকল্পনা ও প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে জ্বালানি খাতের নীতি-কাঠামো বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্ট দাতাদের কাছে অনেকাংশেই জিম্মি। আইনি দুর্বলতা, নীতিকাঠামোর জিম্মিদশা এবং স্বচ্ছতার ঘাটতিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে রাষ্ট্র ও জনগণের ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে সরকারের অঙ্গীকার ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি থাকলেও এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রণয়ন ও উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন বিষয়ক সিনিয়র রির্সাচ ফেলো মো. মাহ্ফুজুল হক এবং একই বিভাগের রির্সাচ ফেলো মো. নেওয়াজুল মওলা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা, অনুমোদন এবং বাস্তবায়নের নীতিকাঠামো বিশ্লেষণসহ সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গুণগত এই গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। তথ্য সংগ্রহের জন্য গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সংগতি রেখে বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাঁশখালী এস এস বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মাতারবাড়ী এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্র এই ৩টি প্রকল্প বেছে নেওয়া হয়েছে।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানি খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে দাতানির্ভর নীতি ও পরিকল্পনা করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী কর্তৃক বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের ‘পলিসি ক্যাপচার’ হয়েছে। আইনি দুর্বলতার সুযোগে উদ্বৃত্ত কয়লা প্রযুক্তি বাংলাদেশে রপ্তানি করার মাধ্যমে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে অধিক দুর্নীতি এবং দ্রুত মুনাফা তুলে নেওয়ার সুযোগ থাকায় প্রয়োজন না থাকলেও কয়লা এবং এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারে সরকারের উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেই। অন্যদিকে, প্রভাবশালী মহলকে অনৈতিক সুবিধা দিতে প্রকল্প অনুমোদন, বিবিধ চুক্তি সম্পাদন, ইপিসি ঠিকাদার নিয়োগ, বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ এবং বিদ্যুৎ ক্রয়ে প্রতিযোগিতাভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার না করে বিশেষ বিধানের আওতায় চুক্তি ও কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়েছে। কয়লা এবং এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পরিবেশ আইন লংঘন করে এবং নির্ভুল পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে বন, নদী, খাস জমিসহ প্রাকৃতিক সম্পদের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং পুলিশের গুলিতে আন্দোলকারীদের মৃত্যুসহ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও বিচার না হওয়ায় অপরাধীদের এক প্রকার দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে; যা এখাত সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীদের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে আরও উৎসাহিত করছে।
বাংলাদেশ সরকার জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি) নিজেরা প্রস্তুত করতে পারেনি। বরং জাইকার অর্থ গ্রহণ করায় জাইকা একই প্রতিষ্ঠানকে (টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি-টেপকো) বারবার পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। ফলে জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে জাপানের নিজস্ব ব্যবসা সম্প্রসারণের স্বার্থে কয়লা এবং এলএনজিকে প্রধান্য দিয়ে বাংলাদেশের জ্বালানি মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে। তাছাড়া, পিএসএমপি প্রস্তুতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়নি। পিএসএমপিতে (২০১৬) ভবিষ্যৎ জ্বালানি চাহিদা নিরূপণে অসঙ্গতি ও ভুল পদ্ধতির কারণে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এর মোট ৬২ হাজার ৭০২ কোটি টাকার পুঞ্জিভূত ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া জ্বালানি মিশ্রণে আমদানি নির্ভর কয়লা ও এলএনজিকে অধিক গুরুত্ব দেয়ায় বারবার নীতির পরিবর্তনে এক দশকে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৯১ শতাংশ বৃদ্ধিসহ মোট ৯ বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। পিএসএমপি (২০১৬) প্রস্তুতে জ্বালানি ব্যবস্থার রূপান্তরকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়নি। বিশেষ করে, বৈশ্বিক বাজারে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন খরচ ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত কমলেও এই জ্বালানিকে গুরুত্ব প্রদানে ঘাটতি রয়েছে। পিএসএমপি (২০১৬)-তে জ্বালানি উৎপাদনে গুরুত্ব দেয়া হলেও সঞ্চালন লাইন প্রস্তুতে গুরুত্বে ঘাটতি আছে।
এছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর মাধ্যমে অপরিকল্পিতভাবে রেন্টাল/কুইক রেন্টালসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই আইনের অধীনে গৃহীত প্রকল্পে সম্পাদিত বিবিধ কার্যক্রমের বৈধতা সম্পর্কে আদালতের এখতিয়ার রহিত করা হয়েছে। ফলে, বাস্তবায়নকৃত কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট আইনের লংঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি সম্পর্কে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। কিছু ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) গত ১০ বছরে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ না থাকায় সরকার তাদের ৪৩ হাজার ১৭০ কোটি টাকা অন্যায্যভাবে পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর বিভিন্ন ধারার দুর্বলতার সুযোগে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় প্রকল্প গ্রহণ হয়েছে। প্যারিস চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ শর্তহীনভাবে ৫ শতাংশ এবং তহবিল প্রাপ্তিসাপেক্ষে ১৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বরং সুপার ক্রিটিক্যাল ও আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির নামে কয়লা প্রকল্প বাস্তবায়ন অব্যাহত রয়েছে এবং প্রস্তাবিত ১৮টি প্রকল্প থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর ১ লাখ ১০ হাজার টন কার্বন নিঃসরণের আশঙ্কা রয়েছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, কয়লা এবং এলএনজিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না থাকায় আমদানি নির্ভর প্রযুক্তি দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে চীন ও জাপানের পুরাতন এবং ব্রাউন ফিল্ড বয়লারগুলোকে গ্রীন নামে চালিয়ে দেওয়াসহ উন্নত দেশের উদ্বৃত্ত ও অব্যবহৃত কয়লা প্রযুক্তির ‘ডাম্পিং ক্ষেত্র’ হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠে এসেছে। অভ্যন্তরীণ কয়লা ও গ্যাসের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিতে সক্ষম না হওয়ায় আমদানি নির্ভর জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। দরকষাকষির ক্ষেত্রে সক্ষমতার অভাবে উচ্চ সুদে বিদেশি ঋণ গ্রহন করা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, গবেষণায় অন্তর্ভূক্ত তিনটি প্রকল্পের অনুমোদন, পরিবেশগত ছাড়পত্র, ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্রয়, ক্ষতিগ্রস্তদের পুর্নবাসন ও কর্মসংস্থান এবং ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানে যেমন অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তেমনি প্রয়োজনের অধিক জমি ক্রয় বা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারক এবং মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে যথাযথ বিশ্লেষণ না করে প্রভাবশালীদের স্বার্থে কয়লা ও এলএনজি প্রকল্প অনুমোদনের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন দেশে (ভারত, চীন, পাকিস্তান ও অষ্ট্রেলিয়া) নির্মিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দামের তুলনায় ২২-৪৯ শতাংশ পর্যন্ত বেশি মূল্য নির্ধারণ করে প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং অধিক মূল্যে জ্বালানি ক্রয়ের প্রস্তাবনাও মেনে নেয়া হয়েছে। পরিবেশগত সমীক্ষার ক্ষেত্রেও অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এমনকি পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই মাতারবাড়িতে নির্মাণকাজ চলছে।
তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনের অধিক প্রায় ৯৪২ একর জমি ক্রয় কিংবা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এতে শুধু ভূমি ক্রয়/অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানে মোট ৩৯০ কোটি ৪৯ লাখ টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এছাড়াও কৃষি জমি, বন, নদী ও খালসহ স্থানীয় আদিবাসী ও লবণ চাষীসহ বিভিন্নজনের জমি জোরপূর্বক দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জমি অধিগ্রহণে জমির মালিকদের হয়রানি করা হলেও এমন অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। এমনকি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা হয় না। প্রকল্পের স্থান নির্বাচন এবং পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত না করার পাশাপাশি প্রকল্পের ফলে পরিবেশের ক্ষয়-ক্ষতি সম্পর্কেও স্থানীয় জনগণের মতামত পরিবেশগত সমীক্ষাতে গ্রহণ করা হয়নি। আবার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিসহ অন্যান্য অংশীজনের সম্পৃক্ততাও নিশ্চিত করা হয়নি। এছাড়া স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, জীবিকা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিতে ব্যাপক ঘাটতি রয়ে গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দেশের জ্বালানি খাত বিকাশের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দাতা সংস্থা এবং বিনিয়োগকারীদের ওপর অতি নির্ভরশীলতায় এখাতের নীতিকাঠামো অনেকাংশেই জিম্মি হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। পাশাপাশি, এখাতে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীদের অধিক লাভের আশায় জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা এবং স্বার্থান্বেষী মহলের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি বিদ্যমান। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি ব্যবহার না করে বিশেষ বিধানের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাব যথাযথভাবে মূল্যায়ন না করে প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হয়েছে।”
জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্পের বিরোধিতা করতে গিয়ে পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনকারীদের অনেকেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে ড. জামান আরও বলেন, “ইতিমধ্যে ১০টি কয়লা ও এলএনজি প্রকল্প বাদ দেওয়া হলেও ২০৩০ সাল পর্যন্ত যেসব কয়লা ও এলএনজি প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে রয়েছে, যা উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে (১৮ক অনুচ্ছেদ) পরিবেশ সুরক্ষা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া প্যারিস চুক্তি এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে উত্তরণে অগ্রসর হওয়ার কথা। অথচ কয়লা ও এলএনজি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে উল্টো পথে হাঁটা হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক মাতারবাড়ি প্রকল্পে যে জাইকা অর্থায়ন করেছে- যারা তাদের দেশের কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন প্রযুক্তি বাংলাদেশে রপ্তানি করতে আগ্রহী- তাদের হাতে নতুন সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পিত হওয়া স্বার্থের দ্বন্দের কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা তৈরি করছে।
তিনি বলেন, “বৈশ্বিকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে এবং একইসাথে এখাতে প্রযুক্তির উত্তরোত্তর অগ্রগতির সুযোগ আমাদের অবশ্যই নিতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ ও প্রকল্প অনুমোদন এবং বাস্তবায়নে স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নির্ভর ক্রয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে আমরা বিনিয়োগের যথাযোগ্য মূল্য পাব এবং এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আরও উৎসাহিত হবে। সংশ্লিষ্ট দাতা ও জীবাশ্মভিত্তিক বিদ্যুতে বিনিয়োগকারীদের হাতে জিম্মি অবস্থা থেকে বেরিয়ে সাংবিধানিক অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পরিবেশ ও জনবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্পের দিকে সুনির্দিষ্ট সময়াবদ্ধ কৌশল অনুযায়ী আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।”
সংবাদ সম্মেলনে জ্বালানি খাতের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে টিআইবির পক্ষ থেকে সাত দফা সুপারিশ করা হয়। সেগুলো হলো- জ্বালানি খাতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংশ্লিষ্টদের বাদ দিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক উপায়ে প্রস্তাবিত ইন্ট্রিগ্রেটেড এনার্জি এন্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান (আইইপিএমপি) প্রণয়ন করতে হবে এবং একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপসহ প্রস্তাবিত আইইপিএমপি’তে কৌশলগতভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দিতে হবে; বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ বাতিল করতে হবে এবং ২০২২ সালের পরে নতুন কোনো প্রকার জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থায়ন না করার ঘোষণা দিতে হবে; জ্বালানি প্রকল্প অনুমোদন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি সম্পাদন, ঋণের শর্ত নির্ধারণে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও শুদ্ধাচার নিশ্চিত করতে হবে এবং এসংক্রান্ত সকল নথি প্রকাশ করতে হবে; জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের ক্ষতি রোধ এবং জীবন-জীবিকা ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় চলমান ঝুঁকিপূর্ণ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থগিত করে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ কৌশলগত, সামাজিক ও পরিবেশগত সমীক্ষা করে অগ্রসর হতে হবে; জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অনুমিত অবদান (আইএনডিসি) এর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে পরিকল্পনাধীন কয়লা ও এলএনজি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে সৌরসহ নাবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে; ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া, ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ ও বিতরণ এবং ক্রয় সংক্রান্ত কার্যক্রমে শুদ্ধাচার নিশ্চিত করতে হবে; প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত দুর্নীতির তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।