তেলের পড়তি দাম যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে
গত জুন মাসের শেষের দিক থেকে অশোধিত তেলের দাম ব্যাপক হারে কমতে শুরু করায় তা বিশ্বজুড়ে সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়। এ নিয়ে অনেক স্ববিরোধী ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। অনেকেই বলছেন, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার আশঙ্কার কারণেই তেলের দামের এ পতন ঘটেছে। আবার অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিকেই এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব গোপন আঁতাত করে ইরান ও রাশিয়ার মতো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার লক্ষ্যেই অন্য আরও কারণের সঙ্গে এটা করেছে—অনেকের মনেই এ সন্দেহ আছে।
কারণ যা-ই হোক না কেন, ফলাফল তো সেই একই। হয়তো এসব কারণের মধ্যে কয়েকটি কারণের মিলিত ফলাফল হিসেবে এটি ঘটেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ক্রিস্টিন লাগার্ড বলেছেন, তেলের দাম কমায় বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যেতে পারে। যেসব দেশ তেল আমদানি করে তারা লাভবান হবে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় যে প্রচেষ্টা চলছে, তার ওপর এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে।
হ্যাঁ, তেলের দাম কমে যাওয়ায় নবায়নযোগ্য শক্তি বর্তমান বাজারে জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় শুধু পিছিয়েই পড়বে না, এর ফলে এ–বিষয়ক গবেষণা ও বিনিয়োগও আর তেমন একটা হবে না। ফলে ভবিষ্যতেও নবায়নযোগ্য শক্তি আর প্রতিযোগিতায় থাকতে পারবে না। আরও সাধারণভাবে বললে ভোক্তা, কোম্পানি ও সরকারগুলো আর শক্তি ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার তাগিদ বোধ করবে না বা উৎসাহিত হবে না।
এমনকি আমরা তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার যে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রির বেশি বাড়তে না দিতে চেষ্টা করছিলাম, সেটা অর্জন করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তাপমাত্রা বাড়ার হার এর চেয়ে বেশি হলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব খুবই মারাত্মক হবে। ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, ফলে আমরা কাজে ঢিলা দিতে পারি না।
জলবায়ু বিজ্ঞান একদম খাপে খাপ কাজ করে না। এটা সম্ভাব্যতার একটি কাঠামোর মধ্যে কাজ করে। কিন্তু আনুমানিক হিসাব ভুল হলে ঝুঁকি কমার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।
বিশ্বনেতারা ক্রমেই এটা অনুধাবন করছেন, তবে তাত্ত্বিকভাবে। পেরুর লিমায় সদ্য সমাপ্ত জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সম্মেলনেও এটা দেখা গেছে। কিন্তু তাঁরা কোনো বাধ্যতা সৃষ্টিকারী প্রতিশ্রুতি দিতে চান না। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে দুনিয়া খুবই মারাত্মক পথে চালিত হচ্ছে। তেলের দাম ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় কার্বন পোড়ানোর ব্যয় বাড়ানোর এক বিরল রাজনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সর্বোপরি, কার্বন করের বিরুদ্ধে যে যুক্তিটি সব সময় পাড়া হয়, তা হচ্ছে এর ফলে জ্বালানির দাম আরও বেড়ে যাবে। এমনকি এই করের টাকা আবার করদাতাদের কাছেই ফেরত যাবে—এমন আশ্বাসবাণীর পরও কার্বন করের বিরুদ্ধে বিরাজমান রাজনৈতিক বাধা দূর করা সম্ভব হয়নি। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে এ বাধা খুবই প্রবল।
তেলের দাম কমে যাওয়ায় এ খাতে এখন আর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে না। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে তেলের দাম না বাড়িয়ে কার্বন কর আরোপ করা সম্ভব। তেলের দাম কমার কিছু সুবিধা ভোগ থেকে নীতিপ্রণেতাদের সরে আসতে হবে। বস্তুত, এর পরও দাম এতটা কম আছে যে ভোক্তারা এ থেকেও লাভবান হবে। হয়তো এখন যে হারে হচ্ছে, সে হারে নয়।
কার্বনের দাম নির্ধারণের কাঠামো ঠিক করা নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। এর একটি দিক হচ্ছে, তেলের দামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে কার্বনের দাম নির্ধারণ করা। অর্থাৎ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। যেমন ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম পাঁচ ডলার কমলে কার্বন করের হার একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় বাড়ানো যায়। আবার তেলের দাম পাঁচ ডলার বাড়লে সেই করের পরিমাণ কমানো যায়, যেমন তা ওই হারের দুই-তৃতীয়াংশ হারে কমানো যায়।
ফলে কার্বন পোড়ানোর দাম সময়ের সঙ্গে বাড়বে। প্রবৃদ্ধি মডেল অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় যা যা করা হয়েছে, এটাই তার সবচেয়ে ভালো ফল। একই সঙ্গে তা ভোক্তাদের তেলের দামের ওঠানামার প্রভাব থেকে রক্ষা করবে, এর পেছনে ব্যয়ের পরিমাণও স্থিতিশীল থাকবে। শেষমেশ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, এরূপ একটি পদ্ধতি থাকলে তা নির্ধারিত কার্বন করের ব্যবস্থার চেয়ে অনেক আকর্ষণীয় হবে। বিশেষ করে, তেলের দাম ব্যাপক হারে কমার সময় যদি এটা প্রবর্তন করা যায়।
সংক্ষেপে বলা যায়, বিশ্বনেতাদের উচিত, তেলের দাম কমার সুযোগে কার্বন পোড়ানোর পরোক্ষ কর আরোপ থেকে প্রকাশ্য কার্বন কর আরোপের দিকে যাওয়া। এর ফলে দুনিয়াকে আরও টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত করা সম্ভব। কার্বন নিঃসরণের ওপর কর আরোপের মধ্য দিয়ে তা অর্জন করা যায়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, প্রকৃত প্রভাব অনুভূত হতে হলে সব বড় দেশেই কার্বন কর আরোপ করতে হবে।
সব দেশেই শক্তি-সম্পর্কিত নানা রকম পণ্যে নানা রকম কর, ফি আরোপ ও ভর্তুকি দেওয়া আছে। বড় দেশগুলোতে পরিবর্তনশীল কার্বন কর আরোপ করা হলে তা গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
আজ তেলের দাম কমে যাওয়ায় এ পদেক্ষপ নেওয়া সম্ভব। তবে এটা ন্যায়সংগত হওয়া উচিত, যাতে তা রাজনৈতিকভাবে সম্ভব হয়, পরিবর্তনশীল হয়। যাতে তা ভোক্তার ব্যয় স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখে। কার্বন করের পরিমাণ সময়ের সঙ্গে বাড়াতে হবে। দুনিয়াকে টেকসই উন্নয়নের পথে চালিত করতে হলে এর বিকল্প নেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এটা দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ এই সুযোগ দীর্ঘদিন উন্মুক্ত থাকবে না।
কামাল দারভিস: তুরস্কের সাবেক অর্থমন্ত্রী
সৌজন্যে: প্রথম আলো
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট