তেল-যুদ্ধ ও সৌদি অগ্রাধিকার
যখন থেকে বিশ্বে তেলের বাজারের দর পড়তে শুরু করেছে, তখন থেকে সবাই সৌদিদের দিকে অঙুলি নির্দেশ করে রেখেছে। কারণ, ভূ-রাজনীতির লক্ষ্ অর্জনের জন্য সৌদিরা আগে কয়েকবারই তেলের দাম নিয়ে ম্যানিপিউলেশন করেছে! অন্যভাবে, তেল-অস্ত্র ব্যবহার করেছে। সৌদি আরব পৃথিবীর বৃহত্তম তেল-উৎপাদনকারী ও রফতানিকারক দেশ, সঙ্গে রয়েছে ওপেকের আরও এগারোটি দেশ।
সৌদিরা প্রথম তেল-অস্ত্র ব্যবহার করে ১৯৭৩ সালে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের বুদ্ধিমতো সৌদি রাজা ফয়সাল ইজরাইলি সমর্থনের জন্য মার্কিনীদের শাস্তি দিতে তেলের উৎপাদন কমিয়ে দাম বাড়িয়ে দেন এবং সঙ্গে তেল-নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বসেন। কাজ হয়। তেলের মূল্যের চারগুণ বৃদ্ধি মেনে নেয়া হয়, এই সুপরিচিত ‘তেল-মূল্য শক’ সৌদিরাসহ ওপেক দেশগুলোকে রাতারাতি ধনী দেশে পরিণত করে। অবশ্য কৌশলী প্রেসিডেন্ট নিক্সন ‘পেট্রো-ডলার রিসাইক্লিং সিস্টেম’ ব্যবস্থা আদায় করে নেন, এবং ফিলিস্তিনি ইস্যুর অদ্যাবধি কোনো সুরাহা হয়নি, কবে হবে বা আদৌ হবে কি, কে জানে!
সৌদি নেতৃত্বে ওপেক দেশগুলো ১৯৮৬ সালে, ১৯৯০ ও ১৯৯৮ সালেও তেলের মূল্যের ‘খাড়াপতন’ অব্যাহত রাখে। পর পর এই তিন দফায় সৌদি ক্রোধ বা রোষের কারণ সম্ভবত ছিল, যথাক্রমে : বৃহত্তম সৌদি তথা ওপেকের, প্রধান তেল আমদানিকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব তেল উৎপাদন বাড়িয়ে দেয় এবং ফলে, তেল-আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়। তাই ওপেকের ‘মার্কেট -শেয়ার’ সংরক্ষণের চেষ্টা প্রাধান্য পায়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ‘কুয়েত’ নামক হারানো ভূ-খণ্ডটিকে ফেরত পাওয়ার জন্য সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমণ করলে সৌদিরা খুবই ক্ষেপে যায়। কুয়েত ওপেকের সদস্য, ইরাকও। সাদ্দাম হোসেনকে ‘রাজনৈতিক আক্কেল’ দেয়ার জন্য তেলের ‘প্রাইস-ওয়ার’ শুরু হয়। এই সময়ে, সৌদিরা সম্ভবত ‘সোভিয়েট ইউনিয়ন’কেও—তাদের তেল-আধিপত্যের প্রতি হুমকিস্বরূপ দেখতে শুরু করে। ফলে, দ্বিতীয় প্রায়োরিটি হিসেবে ‘সোভিয়েট ইউনিয়ন’ও হয়তো লক্ষ্যবস্তু ছিল। তবে রুশদের সৌদিরা ঘায়েল করতে সক্ষম হয় কয়েক বছর বাদে। ১৯৯৮ সালে সৌদিরা যখন তেলের দাম পঁচিশ ডলার থেকে অর্ধেকে নামিয়ে আনে, অর্থাত্, ব্যারেল প্রতি দাম বারো ডলার হয়—বরিস ইয়েলিসনের রুশ ফেডারেশন ঋণ পরিশোধের আইনি প্রশ্নে ‘ডিফল্ট’ করে।
অবশ্য উৎপাদন কমিয়ে তেলের মূল্য কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি করে ‘পেট্রো-ডলারের’ বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা যে সৌদিরাসহ ওপেকের সদস্যরা করেনি, তা নয় কিন্তু। যেমন, ২০০৮ সালে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ১৪৭ ডলার হয়েছিল।
২০১৪ সালে, সৌদিরা সর্বশেষ যে ‘প্রাইস-ওয়ার’ তথা মূল্য-যুদ্ধের সূচনা করে, বেশ রহস্যময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই তার অবতারণা ঘটে। ঐ বছরের জুন মাসে আইএস বা আইসিসরা ইরাকের তেল-সমৃদ্ধ মসুল ও কিরকুক এলাকা হঠাৎ করে দখল নেয়ার পরপরই অশোধিত ব্রেন্ট তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১১২ ডলার থেকে নেমে হয় ৮৮ ডলার (প্রায় কুড়ি শতাংশ মূল্য হ্রাস)। অথচ, বৈশ্বিক তেলের প্রতিদিনের চাহিদা কিন্তু কুড়ি শতাংশ কমে যায়নি। এমনকি চীনের চাহিদারও কুড়ি শতাংশ কমতি ঘটেনি বা যুক্তরাষ্ট্রের শেইল তেলের উৎপাদনও কুড়ি-একুশ শতাংশ বৃদ্ধি পায়নি। অতঃপর, আইএস বা আইসিস বিরোধী ‘ইচ্ছুকের দলের’ (কোয়ালিশন অব দি উইলিং বা ন্যাটো) বোমাবর্ষণ অভিযানের মাধ্যমে পৃথিবীর সমৃদ্ধতম তেল-সম্পদ অধ্যুষিত এলাকাটিতে যুদ্ধের সূচনা হতে না হতেই, অপরিশোধিত তেলের মূল্যও নেমে যেতে থাকে এবং খুবই নাটকীয়ভাবে। কারণ, দাম কমে যাচ্ছে, কিন্তু উৎপাদনের লাগাম টানার কোনো আগ্রহই ওপেকের নেই! ওপেকের পরবর্তী মিটিং হবে ২০১৫ সালের জুন মাসে। তাই বলা চলে যে জুন পর্যন্ত তেলের দাম কমই থাকবে এবং এমনকি দাম কমে, ব্যারেল প্রতি কুড়ি ডলার হলেও হতে পারে (সৌদিরা তাই বলেছে)।
এই দফায়, মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সৌদিরা সস্তার তেলে বাজার সয়লাপ করার ‘পাগলামিতে’ নেমেছে, সেটি কিন্তু এখনো ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। হতে পারে যে বিশ্ব তেলের বাজারে, রুশ, ইরান, সিরিয়ার অবস্থান দুর্বল করে দেয়ার জন্য, বা হতেও পারে যে শেইল উৎপাদনকারী মার্কিনীদের হটিয়ে মার্কেট শেয়ার অক্ষুন্ন রাখার জন্য। বা হয়তো চলছে সিরিয়া বিরোধী কোনো ‘গোপন কিন্তু নির্বোধ মূঢ় সৌদি-মার্কিন গ্যাস পাইপলাইনের যুদ্ধ’।
তবে অর্থনীতি’র বিবেচনায়, সস্তার তেলে বাজার সয়লাপ অব্যাহত থাকলে, ওপেকের সবাইই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য! এমনকি ধনীতম দেশ সৌদি আরবেরও পার পাওয়ার উপায় নেই কোনো। ১৯৭৩ সালের স্বর্ণময় দিনগুলোর মুহূর্ত সৌদিদের জীবনে দ্বিতীয়বার আর আসেনি। আসবেও না আর। সৌদিদের মোট রাষ্ট্রীয় আয়ের নব্বই শতাংশ, তেল বিক্রির ওপর নির্ভরশীল এবং সম্পূর্ণ অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার বাহন তেলের টাকা। কাজেই, তেলের পড়তি দাম অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে বাধ্য। যেমন, ১৯৯৮ সালের সঙ্কটের সময়, বর্তমান রাজা আব্দুল্লাহ ‘প্রাচুর্যের যুগের ইতি’র ঘোষণা দেন এবং বলেন যে, ‘রাষ্ট্রের উপরে সার্বিক নির্ভরশীলতা আর চলতে পারে না’। সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনতে সৌদিরা কৃচ্ছ তার কর্মসূচি গ্রহণ করে। ফলে, সরকারি চাকরি, সরকারি প্রজেক্টের সংখ্যা নিদারুণভাবে কমিয়ে আনা হয়। তবে বেসরকারি খাত গড়ে ওঠেনি বলে চাকরি সৃষ্টিও সম্ভব নয়। কিছু কিছু কৃষিজ পণ্যের ভর্তুকি বাতিল করা হয় এবং পেট্রোল, বিদ্যুত্, ভ্রমণ, ভিসাসহ কয়েকটি সরকারি সেবা-ফি’য়ের পরিমাণ বাড়ানো হয়। বা যেমন, ১৯৮০-এর দশকের সঙ্কটের সময় মাথা পিছু আয়ের পরিমাণ পঞ্চাশ শতাংশ নেমে যায়। কিন্তু একমাত্র সৌদি তেল কোম্পানি আরামকো-র তেল-নীতি সম্বন্ধে সৌদি সমাজ মোটেই অবহিত নয়।
সৌদিদের ২০১৫ সালের বাজেট ঘাটতি অন্যবারের চেয়ে কিছুটা বেশি (সৌদি গেজেট অনুযায়ী)। ঘাটতি পূরণের জন্য এবারেও রাজকীয় রিজার্ভে হাত দিতেই হচ্ছে। বিশেষ করে, ২০১১ সালের আরবীয় বসন্ত সৌদিদের নিরন্তর এমন এক সচকিত উত্কণ্ঠা ও অস্বস্তির মধ্যে রেখেছে যে ‘রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ স্থগিত রাখতে হয়েছে। বরং অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ রোধের ব্যবস্থা হিসেবে বেকারভাতা, গৃহায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে ব্যয়বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেয়া হয় (বছরে ২৫০ বিলিয়ন ডলার)। এক্ষেত্রে তাই ব্যয়-সংকোচন সম্ভব নয়। তদুপরি অসামরিক ও সরকারি সংস্থাপনগুলোর নিরাপত্তা বিধানের জন্য নতুন ষাট হাজার নিরাপত্তা চাকরি সৃষ্টি করা হয়েছে, সামরিক অস্ত্র আমদানিও বেড়েছে। আইসি দমনে সক্রিয় সৌদি অংশগ্রহণও ব্যয়-বৃদ্ধির আরেকটি সংযোজন। শিয়া-অধ্যুষিত তেল-সমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে, শিয়াদের বিরুদ্ধে আইসি সমর্থক জিহাদি তত্পরতা রোধেও সৌদি কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। বর্তমানে, সামরিক ব্যয়-খাতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রুশদের পরেই সৌদিরা অবস্থান করছে।
আবার আরবীয় বসন্তের কারণে সৌদিরা রাজনৈতিক কমিটমেন্টের পরিসরও বৃদ্ধি করেছে। ফলে, প্রাইস-ওয়ারের দুর্দিনেও বাহরাইন, ওমান, মিসর, লেবানন, জর্ডান, মরক্কো, ইয়েমেন, পাকিস্তান ও সিরিয়ার আসাদ-বিরোধীদের অর্থ সাহায্য পাঠাতে হচ্ছে। এই অর্থ-সাহায্যও কৃচ্ছ্রের আওতায় আসবে কিনা, রাজা কিছু বলেননি। তবে রাজপরিবার, বিশেষ করে রাজা আব্দুল্লাহ্ নীতিগ্রহণের প্রশ্নে সূক্ষ্ম উভয়-সঙ্কটের মধ্যে রয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের পরিপ্রেক্ষিতে, সৌদিরা মূলত মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোকেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গ্রহণ করেছে, কাছের দেশগুলোর অনেকেই অবন্ধু দেশ। সত্তরের দশকে, ফিলিস্তিনি প্রশ্নে, তেল-সমৃদ্ধ সৌদিরা যে লিডারশিপের প্রতিশ্রুতির ঝলক দেখিয়েছিল, সেটির আর সহজাত প্রবৃদ্ধি হতে পারেনি। এ জন্য সৌদিদের কূটনৈতিক একরৈখিকতাকে দায়ী করা চলে।
তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি একশো ডলারের বেশি হলেই, এই প্রবৃদ্ধমান ব্যয়ের মসৃণ সমাধান সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা অন্যবিধ। সৌদিদের রাজকীয় রিজার্ভে হাত দিতেই হচ্ছে। সৌদিরাও জানে যে, যেকোনো যুদ্ধের মতোই, ‘প্রাইস ওয়ারে’ও হতাহতের শামিল সবপক্ষই হয়ে থাকে। সৌদিরা কি নীতি বদলের কথা ভাবছে না?
লেখক : সাংবাদিক
সৌজন্যে: দৈনিক ইত্তেফাক