দাম নির্ধারণে নতুন ভাবনা প্রয়োজন
বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম পণ্য বা সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করে কার্যত সরকার। মূলত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী আদেশে এই দাম নির্ধারিত হয়। ফলে জ্বালানি তেলের প্রকৃত দাম বা বিশ্ববাজারের দামের তুলনায় কখনো সরকার, আবার কখনো ক্রেতাসাধারণ আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে এসেছে।
জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের এই পদ্ধতিকে স্বচ্ছ বলা যায় না। কারণ এ পদ্ধতিতে ভোক্তার অজ্ঞাতসারে কিছু অন্যায্য শুল্ক ও কর আরোপের সুযোগ আছে। তাই সরকারের নির্ধারিত দাম ন্যায্য বলে মানুষ বিশ্বাস করতে দ্বিধা করে। অধিকাংশ সময় শুধু এই অবিশ্বাসের ফলে সরকার যখন দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার প্রতিবাদ হয় বিক্ষোভে, বিবৃতিতে নানাভাবে।
এই সমস্যা এড়ানোর সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো জ্বালানির দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি ¯^চ্ছ করা। স্পষ্ট আইন-কানুনের অধীনে বাজারভিত্তিক দাম নির্ধারণের পথে যাওয়া। অবশ্য বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে বাজারভিত্তিক দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া ও কার্যকর করা সহজ নয়। তবে বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের প্রতিবেশী ভারত এই গুরুত্বটা অনেক আগেই বুঝেছে। তাই তারা বাজারভিত্তিক দাম নির্ধারণের পদ্ধতি চালু করেছে। ফলে সেখানে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিনিয়ত জ্বালানির দাম সমন্বয় হয়। জ্বালানির দামের ওঠানামা নিয়ে গণমাধ্যমে নিয়মিত খবর প্রকাশিত হয়। মানুষ বুঝতে পারে যে, তাদের দেশে জ্বালানি তেল পুরোটাই আমদানি করা। তাই বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই দাম নির্ধারিত হবে। সরকারি ভর্তুকিতে এই খাত চলতে পারবে না। মানুষের কাছে পুরো বিষয়টিই পরিষ্কার থাকে। তাই সেখানে জ্বালানির দামের বিষয়ে আমাদের দেশের মতো প্রতিবাদ সহসা দেখা যায় না।
কিন্তু বাংলাদেশে বাজারভিত্তিক দাম নির্ধারিত না হওয়ায় দীর্ঘদিন জ্বালানি তেলের দাম অপরিবর্তিত থাকে। তারপর যখন বাড়ানো হয় তখন মানুষ মনে করে সরকার মানুষের ওপর আবার একটা করের বোঝা চাপাচ্ছে। সরকার ও দেশবাসীর মধ্যে একটা অনাস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
গ্যাসের দাম নির্ধারণেও বাজারভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন, বিশেষ করে যখন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম সরকারকে দেশের গ্যাসের একটা দাম নির্ধারণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশের গ্যাসের সঙ্গে যে পরিমাণ আমদানি করা এলএনজি যুক্ত হবে তার ভিত্তিতে তিন-চার মাসের ব্যবধানে নিয়মিত দাম পুনর্নির্ধারণের পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে প্রতিনিয়ত এলএনজির দাম উল্লেখ করতে হবে। তৃতীয়ত, দেশের ক্ষেত্রগুলোতে গ্যাসের মজুদ, চাপ, উত্তোলন বাড়া-কমা প্রভৃতি তথ্য নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে, যাতে মানুষ দেশের গ্যাস পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারে। মোট কথা, দাম বাড়ানো-কমানো যে স্বচ্ছ নীতির অধীনে করা হচ্ছে সে কথা যেন মানুষ বুঝতে পারে।
বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ এর চেয়ে কিছুটা ভিন্নতর ও একটু জটিল। কারণ বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের জন্য বিনিয়োগ, জ্বালানি খরচ এবং সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় যুক্ত করতে হয়। তাছাড়া, উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে ‘মেরিট বেইজড’ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় কি না, সম্ভাব্য সর্বনিম্ন দামে উৎপাদনের জন্য জ্বালানি মিশ্রণের সঠিক প্রক্রিয়া অনুসৃত হয় কি না, সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মান প্রভৃতিও হিসাবে নিতে হয়। সর্বোপরি গ্রাহকের স্বার্থ বিবেচনা বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এগুলো সবই রেগুলেটরি কমিশনকে বিবেচনায় নিতে হয়।
আমাদের দেশে বিদ্যমান অবস্থায় গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করে বিদ্যুতের সঠিক দাম নির্ধারণ করার জন্য রেগুলেটরি কমিশনের কতগুলো মৌলিক কাজ করা জরুরি। যেমন- বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের একটি বাস্তবানুগ পূর্বাভাস প্রণয়নের জন্য বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা। চাহিদা পূরণের জন্য যতটা উৎপাদনের ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন (রিজার্ভ মার্জিনসহ) সে অনুযায়ী উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান, যাতে এখনকার মতো প্রচুর পরিমাণে অলস উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি না হতে পারে। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন ঘাটতি যেমন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্তরায় তেমনি প্রচুর পরিমাণে অলস উৎপাদন ক্ষমতাও অর্থনীতি ও বিদ্যুৎ খাতের বাণিজ্যিক অগ্রতির সহায়ক নয়। স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে এমন পুরনো ও জরাজীর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরে পাঠানো বাধ্যতামূলক করে দেওয়া। কয়লাভিত্তিক আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল এবং আরএলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা, যাতে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম হয়।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দামের ভবিষ্যৎপ্রবণতা সম্পর্কে পূর্বাভাস বা ধারণা দেওয়া। এটি বিশেষ করে বিনিয়োগকারী, শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের জন্য বেশি দরকারি। কারণ এটা তাদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনার সহায়ক হয়। সরকার তথা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, সর্বোপরি রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে দায়িত্ব আছে।
ড. ইজাজ হোসেন
অধ্যাপক
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়