নতুন করে ভাবতে হবে

আমাদের আশপাশে আমরা সবাই নতুন কিছু দেখছি। সবাই নতুন কিছু দেখছি, জানছি। বাইরে বেরোনোর ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন ছাদে হাঁটি। সেদিন দেখলাম গাছে নানা রকম পাখপাখালি। আগে কেবল কাক আর কদাচিৎ শালিক দেখেছি। এখন মাথার ওপর চড়ুই উড়ছে। সবুজ টিয়া সবুজ পাতার সঙ্গে মিশে আছে। মাঝে মাঝে কার্নিশে এসে বসছে। ভয় পাচ্ছে না। তবে কি মানবজাতির নপুংসকতার খবর এরই মধ্যে তাদের কাছে পৌঁছে গেছে? আচ্ছা, ধূসর ও কালোয় মেশানো ঝুঁটিওয়ালা পাখির নাম কী? এমনকি বকও দেখলাম, আরো সব নানা বর্ণের, ধ্বনির ও আকারের পাখি দেখলাম। যাদের সবার নামও জানি না। কোথায় ছিল এরা এতদিন। আগেও বহুবার ছাদে হেঁটেছি। এদের কখনো দেখিনি। কেনইবা ওরা আবার বের হলো? তাদের বের হওয়ার জন্য আমাদের অন্তরীণ হওয়া কি আবশ্যক? নাকি বাস্তুচ্যুত মাছ, পশু-পাখিরা আমাদের ঠেলে ঘরের ভেতর পাঠিয়েছে?

শুধু মাছ, পাখপাখালি কেন, চিরচেনা গাছগুলোকেও নতুন লাগছে। আমাদের অন্তরীণ হতে দেখে ওদেরও কি স্বস্তি লাগছে? আমাদের নাগরিক জীবনের কালো ধোঁয়া, নানা বর্জ্যমুক্ত হওয়াতেই কি বৃক্ষদের আনন্দ? টবের ফুলগুলো এবং ওদের পাতারাও কেমন যেন ষোড়শী তরুণীর মতো উচ্ছল! ধরিত্রী কি কেবলই আমাদের? ডলফিনের, পাখপাখালি, বৃক্ষ, তরুলতা, আর অন্য জীবজন্তুর নয়? আমরা কি কেবল কাক, মশা, ইঁদুর, নেড়ে কুকুর আর কালো বিড়ালের সঙ্গে থাকব? সহজ এ প্রশ্নগুলোর জবাব আমার জানা নেই? আপনারা কেউ জানেন কি?
আমাদের দাপটে ডলফিনরা তাদের আবাস ছেড়ে পালিয়েছিল। পালিয়েছে পশু, পাখপাখালি। বৃক্ষ, তরুলতা শ্বাসরুদ্ধ হয়েছিল। এখন তারা হাঁফ ছেড়ে বের হয়েছে। আমরা কি আবার এ যাত্রা রক্ষা পেলে ঘর থেকে বের হয়ে তাদের তাড়িয়ে দেব? এ করোনাভাইরাস যে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, রাজপুত্র, পর্দার, মাঠের নায়ক কাউকেই ছাড় দেয়নি, সে কি আমাদের এত সহজেই ছেড়ে দেবে? করোনাভাইরাস হয়তো একদিন নিয়ন্ত্রণে আসবে, কিন্তু সামনে এর চেয়ে ভয়াবহ ভাইরাস থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে কি?
উপায় আছে। তবে প্রথমেই কবুল করে নিতে হবে যে এ ধরিত্রী কেবল আমাদের নয়। এটা ডলফিন, পশু-পাখি, নাপিত, মিস্ত্রি, চিকিৎসক, গার্মেন্ট মালিক সবার আবাসস্থল। তাই নিজেরা বাঁচার পাশাপাশি অন্যদেরও বাঁচার সুযোগ করে দিতে হবে। নিজেদের এমনভাবে বিচরণ করতে হবে, যাতে অন্যদের বিচরণ করতে অসুবিধা না হয়; নিজের আবাস গড়তে গিয়ে যাতে অন্যের নিবাস ভেঙে না পড়ে। নিজেদের ভোগ যেন অন্যের অভুক্ত থাকার কারণ না হয়।
কবুল করে নিতে হবে যে আমাদের এটা ভোগবাদী সমাজ। তাই সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। আমাদের মোট ভোগের পরিমাণ কমাতে হবে। করোনাভাইরাস সাক্ষী কত কম ভোগে আমাদের জীবন চলে। নিজেদের ভোগের পর এমন অবশিষ্ট রাখতে হবে, যাতে অন্য মানুষ, মাছ, পশু-পাখি, তরুলতার জন্য পর্যাপ্ত অবশিষ্ট থাকে। কেবল নিজেদের ভোগের জন্য বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, বিজলি, পানি ও পয়োনিষ্কাশন, সিনেমা হল, স্টেডিয়াম ও কারখানা গড়ার মারাত্মক নেশা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
ভোগের বিভাজন পরিবর্তন করতে হবে। মোটাদাগে যদি ভোগকে দুই ভাগে ভাগ করি, সামরিক ও বেসামরিক ভোগ, তাহলে সামরিক ভোগের পরিমাণ কমাতে হবে। ২০১৮ সালে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় ছিল ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। একজন ভালো ক্রেতা হিসেবে যদি জিজ্ঞেস করি, কী পেলাম এই ভোগ থেকে? আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ভারত, পাকিস্তান কোথাও কি সামরিক ব্যয় আমাদের কিছু দিয়েছে? অর্থহীন এ ভোগ কমাতেই হবে।
আবার সময় ভোগকে যদি মোটাদাগে দেখি কাজ ও অবসর, তাহলে দেখা যাবে অনর্থক কাজের পেছনে অনেক সময় ব্যয় করছি। ভোগের মোট পরিমাণ কমালে আমাদের কাজের পরিমাণও কমে যাবে। অবসর বাড়বে। পরিবারের জন্য সময় বাড়বে।
মানুষে মানুষে ভোগের ব্যবধান কমাতে হবে। আর তাই কাজের ধরন নির্বিশেষে সবার ন্যূনতম আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আয়ের ব্যবধান কমাতে হবে। একজন বায়োলজিস্ট তো বলেই দিয়েছেন, আপনারা আমাদের মাসে ১ হাজার ৮০০ ইউরো পারিশ্রমিক দেবেন আর একজন ফুটবলারকে দেবেন ১ মিলিয়ন ইউরো! যান, এখন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বা মেসির কাছে যান, তারা আপনাদের ভাইরাসমুক্ত হওয়ার কৌশল বাতলে দেবেন!
যাই হোক, করোনাভাইরাস উদ্ভূত পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ দুটি। প্রথমটি মানুষের জীবন বাঁচানো এবং এ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা। দেশে-বিদেশে কোয়ারেন্টিনের কারণে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আইএমএফ ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী মন্দার সূচনা হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অপেক্ষা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ, রিকশাচালক, দিনমজুর, নাপিত, মিস্ত্রি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ আরও অনেকে। এসব জনগোষ্ঠী সাময়িকভাবে সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে আর্থিক ও খাদ্যসহায়তা পেলেও দীর্ঘ মেয়াদে এটা টেকসই হতে পারে না। কোয়ারেন্টিনের সামাজিক ফলাফল বিশেষত শিশু-কিশোরদের ওপর এর প্রতিক্রিয়া জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। বন্দরে অখালাসকৃত পণ্যের স্তূপ, রপ্তানি হ্রাস, বিদেশে কর্মরতদের দেশে ফিরে আসা সবই আমাদের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক।
এখন এমন একটা দুঃসময়ে অবস্থান করছি, যেখানে অপেক্ষার সামাজিক ও আর্থিক মূল্য অনেক। করোনাভাইরাস আক্রান্ত লোকজন যত দিন অচিহ্নিত থাকবেন, ততই সংক্রমণ ও প্রাণহানি বাড়বে। আবার কোয়ারেন্টিন দীর্ঘমেয়াদি হলে অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়বে। উৎপাদন বন্ধ থাকলে দেশীয় পণ্যের সরবরাহ কমবে, মূল্যস্ফীতি ঘটবে ও রপ্তানি কমবে, রপ্তানিসংশ্লিষ্ট আমদানি কমবে। ফলে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির আয় কমবে। আমদানি ও স্থানীয় উৎপাদন হ্রাসের ফলে রাজস্ব আয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার সঙ্গে যোগ হয়ে দেশের অর্থনীতির এসব বিরূপ প্রভাব পুরো অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলবে।
তাই বাঁচতে হলে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।

লেখক
সাবেক সচিব