নবায়নযোগ্য শক্তি: বিশ্ব প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশ

আজকের আধুনিক জীবন যেমন যন্ত্র ছাড়া অবান্তর, তেমনি জ্বালানি ছাড়া যান্ত্রিক সভ্যতা অসম্ভব। বিশ্বের মোট জ্বালানি চাহিদার আশি ভাগেরও বেশি যোগান দেয় ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম-জ্বালানি। বিশেষ করে পেট্রোলিয়াম তেল, কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। জীবাশ্ম-জ্বালানির উপর আমরা আজ অনেকাংশে নির্ভরশীল।
এই চরম নির্ভরশীলতাই আমাদের ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। গোটা বিশ্ব আজ জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। যার পেছনে রয়েছে মুলত তিনটি কারণ; অনিশ্চিত জ্বালানি নিরাপত্তা, পরিবেশ দূষণ এবং তেল ভিত্তিক ভূ-রাজনীতি। বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় নবায়নযোগ্য শক্তিকেই ভবিষ্যতের সমাধান ভাবা হচ্ছে। পরিবেশকে বাঁচিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী রূপান্তরযোগ্য জ্বালানির পথেই হাঁটতে চাইছে সব দেশ।
বর্তমানে সময়োপযোগী এক প্রকার শক্তি হলো নবায়নযোগ্য শক্তি বা জ্বালানি। বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নতুন নয়। উনবিংশ শতাব্দীতে কয়লা থেকে শক্তি উৎপাদনের কৌশল আবিষ্কারের আগে নবায়নযোগ্য জ্বালানিই ছিল শক্তির একমাত্র উৎস। নবায়নযোগ্য জ্বালানি যে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হচ্ছে তা নয়। হিটিং, যানবাহনের জ্বালানি এবং দুর্গম অঞ্চলে শক্তি সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যেও এ জ্বালানি ব্যবহার হয়। তবে এ শক্তির অধিকাংশই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হয়।
বিশ্বে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশগুলোই সবথেকে বেশি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার করছে। কারণ তাদের নিজ দেশের মানুষের চাপ এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদীদের চাপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, রাশিয়া, ভারত বিশ্বের সব থেকে বেশি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের জন্য রয়েছে আলাদা আইনি বাধ্যবাধকতা এবং ফিড-ইন-ট্যারিফ এর ব্যবস্থা। বিশ্বের সব থেকে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে চীনে। চীন সব থেকে বড় বায়ু ও সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করছে। একশ’রও বেশি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে চীনে। ভারতে বর্তমানে পৃথিবীর সব থেকে বড় সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে। জার্মানিতে সব থেকে বেশি সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। নর্ডিক দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তি বান্ধব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এর প্রসার ঘটাতে সাহায্য করছে। বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে নীতি গ্রহণ করেছে।
পৃথিবীর সমস্ত শক্তি ব্যবস্থায় যে রূপান্তর ঘটছে তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সৌর, বায়ু এবং পানিবাহী শক্তির মত নবায়নযোগ্য শক্তিগুলো। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে, বায়ু দূষণ কমাতে এবং শক্তি উৎপাদন বাড়াতে তাদের ক্রমবর্ধমান স্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সূর্যের আলো আমাদের গ্রহের অন্যতম প্রাচুর্য এবং অবাধে উপলব্ধ শক্তির উৎস। এক ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীর পৃষ্ঠে যে পরিমান সৌর শক্তি পৌঁছে যায় তা পুরো বছরের জন্য গ্রহের মোট শক্তির প্রয়োজনের চেয়ে বেশি।
ভারতের কার্নুল আল্ট্রা সোলার পার্কের মোট উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার মেগাওয়াট, যেখানে ৪০ লাখের বেশি সৌর প্যানেল স্থাপন করা আছে। বায়ু নবায়নযোগ্য শক্তির একটি অন্যতম উৎস। যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সংযোজনের মাধ্যমে তাদের অবদান রেখে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আলতা বায়ু শক্তি কেন্দ্রের মোট ক্ষমতা এক হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট যা ২০৪০ সালের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছানোর আশা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনে বিদ্যুতের জন্য জলবিদ্যুৎ সবচেয়ে বড় নবায়ণযোগ্য শক্তির উৎস। চীনের থ্রি গর্জেস বাঁধটি স্থাপন ও উৎপাদন ক্ষমতার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র (২২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট)।
আরইএন-২১ এর গ্লোবল রিনিউয়েবল রিপোর্ট ২০১৪ অনুসারে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ২০১২ সালে প্রায় ১৯ শতাংশ বৈশ্বিক শক্তি ব্যবহার করেছিল, যা ২০১০ সালে ১৬.৭ শতাংশ ছিল। নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থাগুলো বর্তমানে ইউরোপের বিদ্যুতের এক তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে। একই সাথে, এনার্জি গ্রিড চীনের মোট শক্তির ১/৪ অংশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং জাপানে ১/৬ অংশ পায়। ২০২০ সালে, যুক্তরাজ্য একটি নতুন আশ্চর্যজনক নবায়নযোগ্য শক্তির মাইলফলক অর্জন করেছে। ২০২০ সালের ১০ই জনুয়ারি দেশটি প্রথমবারের মতো নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিশুদ্ধভাবে চলার দুইমাস উদযাপন করেছে। এটি নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য সঠিক দিকের একটি দুর্দান্ত পদক্ষেপ।
২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি কার্যকর হয়েছে যা ২০১৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের ৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ করার পরকিল্পনা করা হয়েছে। সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের জন্য টেকসই এবং নবায়যোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) গঠন করেছে। বর্তমানে জাতীয় সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৫০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। বৈশি^ক ক্ষমতা এক হাজার গিগাওয়াট পৌঁছেছে বলেই জলবিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের বৃহত্তম অংশ। কাপ্তাইয়ে একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে ১৯৬২ সালে। যার বর্তমান ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) আরও দুটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সাঙ্গু (১৪০ মেগাওয়াট) এবং মাতামুহুরী (৭৫ মেগাওয়াট) দুটি স্থান চিহ্নিত করেছে। বায়ো-এনার্জি হল বায়োমাস, বায়ো-পাওয়ার এবং জৈব জ্বালানিসহ যে কোন ধরণের বায়োমাস থেকে উদ্ভূদ শক্তি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল (বিসিএসআইআর) ১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে দেশে বায়োগ্যাস প্রযুক্তি চালু করে। প্রায় ৪০ লাখ বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের সম্ভাব্য বিপরীতে সারা দেশে প্রায় ৭০ হাজার উদ্ভিদ রোপন করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও ভারত থেকে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে তিন শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যেখানে ভারতে তার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ২৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। যা প্রায় ৯০ হাজার ৩৯৯ মেগাওয়াট। দেশটির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩ লাখ ৭৪ হাজার ১৯৯ মেগাওয়াট (জলবিদ্যুৎ বাদে)। অন্যদিকে, পাকিস্তানের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৭ হাজার ৪০২ মেগাওয়াটের (সৌর ও বায়ু বাদে) বিপরীতে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাঁচ শতাংশ (এক হাজার ৮৭০ মেগাওয়াট) উৎপাদন করে।
নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো বর্তমানে বিশ্বের বিদ্যুতের ২৬ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে, তবে আন্তর্জাাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) এর মতে ২০২৪ সালে এর শেয়ারের পরিমান ৩০ শতাংশ পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। আইইএর নির্বাহী পরিচালক ফাতিহ বিরল বলেছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়।
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোঁ বাইডেন আবার প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়বে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেও তিনি ক্রমান্বয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সৌর শক্তি ও বাতাসের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। বাইডেন অনেক দিন থেকেই পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির অংশ হিসেবে তেল-গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রস্তাব করে আসছেন। ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি কাবর্ণমুক্ত হবে এটি তাঁর পরিকল্পনার অংশ।
নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো ব্যবহারের উদ্দেশ্য হল পরিবেশের উপর কয়লা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির প্রভাব কমানো। এ ধরনের সুবজ শক্তির ব্যবহার বেছে নেওয়ার ফলে কেবল দীর্ঘমেয়াদী ব্যয় সাশ্রয় হবে না, সাথে সাথে জীবাশ্ম জ্বালানি দূষনের বিপদ থেকে বায়ুমণ্ডলকে রক্ষা করতে সহায়তা করবে।
নবায়নযোগ্য শক্তি সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য সরকারি পর্যায়ে জ্বালানি সংরক্ষণ সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করতে হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোর ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস এবং তাদের ব্যবহার সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নবায়যোগ্য শক্তি সংরক্ষণ ও প্রয়োগের বিষয়ে বাস্তব সম্মত শিক্ষাদান প্রয়োজন। তাহলেই আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজম্মকে সুন্দর এবং কার্বণ মুক্ত পৃথিবী উপহার দিতে পারব।

লেখক ও গবেষক
সহাকারী অধ্যাপক (গণিত)
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ