নাইকো শুনানি: বিরল অভিজ্ঞতা
এ এক বিরল অভিজ্ঞতা। নিজ দেশে আদালতে বিচারকের সম্মুখীন হতে হয়নি। আর একিনা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আদালত!
নভেম্বর, ২০১৫ সাল। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব ইশতিয়াক আহমেদ আমাকে ডেকে বলেন, ছাতক ভূগঠনের টেংরাটিলায় ব্লো-আউটের ঘটনায় কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেড যে দায়ী সে বিষয়ে আমাকে লন্ডনে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে পেট্রোবাংলা তথা বাংলাদেশ সরকারের হয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে। চেয়ারম্যান মহোদয়ের নির্দেশ শুনে প্রথমে আমি কিছুটা নার্ভাস ফিল করি। তিনি বরাবরই আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। কারণ আমার জীবনে দেশের কোন আদালতে বিচারকের সম্মুখীন হতে হয়নি। আর এটাতো আন্তর্জাতিক আদালত। যাইহোক উনার নির্দেশ মোতাবেক আমি বাপেক্স-এর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব প্রকৌশলী মো. আতিকুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাত করে বিষয়টি অবহিত করি। উনি বিষয়টি অবগত ছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে উনার কথা মত বাপেক্সের ভূতাত্ত্বিক বিভাগের ভূতত্ত্ববিদ জনাব অহিদুল ইসলাম / মেরাজুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ছাতক গ্যাস ক্ষেত্রের টেংরাটিলায় সংঘটিত ব্লো-আউটের পর বিভিন্ন দাপ্তরিক কাগজপত্র দেখা শুরু করি। এই দুইজন কর্মকর্তা আমাকে ভীষণভাবে সাহায্য ও উৎসাহ দেন। একইসঙ্গে ব্লো-আউটে নাইকোর ভুমিকা নিয়ে এবং আমাদের করনীয় কি ছিল সে সকল টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তখন আমার মনে কিছু সাহস সঞ্চয় হয়।
আমি একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছিলাম। আদালতে আমি আমার মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলায় সকল বক্তব্য পেশ করব নচেৎ আমি সাক্ষ্য দিতে যাব না। আদালত আমার এই শর্ত মেনে নেয় এবং বলেন যে দোভাষীর উপস্থিতিতে আমি আমার সকল বক্তব্য পেশ করতে পারব। বাংলাদেশ কর্তৃক নিয়োজিত আইনি পরামর্শক কোম্পানির সাথে বাপেক্সের বোর্ড রুমে টেলি কনফারেন্সের মাধ্যমে আমার সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা হয়। অবশেষে ২০১৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর লন্ডনের উদ্দেশ্যে বাপেক্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যাত্রা করি। পরেরদিন অর্থাৎ ৫ নভেম্বর কোর্টে যাই। আমাদের আইনি পরামর্শক কোম্পানির আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি সন্ধ্যার পর আমাদের নিয়ে কিছু পরামর্শ দেন। উনি সব কিছু সহজভাবে বুঝিয়ে দেন। একটি বিষয়ে বিশেষ করে বিপক্ষের আইনজ্ঞ যখন আমাকে যে প্রশ্নই করুক উনি হ্যাঁ অথবা না এর মাধ্যমে উত্তর দিতে বললেন। সেক্ষেত্রে আমি জেন ফাঁদে পা না দিয়ে বিস্তারিতভাবে বলে উনার প্রশ্নের উত্তর দেই। কোর্টে নিয়ে দুইদিন উপস্থিত রেখে কোর্টের বিভিন্ন নিয়ম কানুন শেখার জন্য অনুরোধ করেন।
কোর্টে কোন রকম শব্দ না করে অবশ্যই নিরবতা পালন করতে হবে।
অবশেষে আমাকে নির্ধারিত দিনে কোর্টে সকালে উপস্থিত করা হয়। আদালতের নিয়োগ দেয়া আমার দুজন দোভাষীর বাড়ি বরিশাল।
নিয়মানুসারে সাক্ষ্য প্রদানকালীন সময়ে আমি ডানে বাঁয়ে অথবা পিছনে ফিরে তাকাতে পারব না, কোন রকম শব্দ বা চোখের ইশারা করতে পারব না। এমন কি বাংলাদেশ কর্তৃক নিয়োজিত নিযুক্ত আইনজ্ঞের দিকেও না। শুধু বিজ্ঞ বিচারক মণ্ডলী এবং প্রতিপক্ষের আইনজ্ঞের দিকে তাকাতে পারব। আমাকে প্রথম প্রশ্ন করেন নাইকো কর্তৃক নিয়োজিত আইন পরামর্শক কোম্পানির একজন বাঙ্গালী আইনজ্ঞ যার সঙ্গে আমার কিছুটা বাক-বিতণ্ডা চলাকালীন সময়ে বিচারক মণ্ডলীর একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক আমাদের তর্ক বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলেন যে, জনাব বাকীর বক্তব্য যুক্তিযুক্ত এবং বিচারক মণ্ডলী সেটাই গ্রহন করবে। অতঃপর তিনি অর্থাৎ বিপক্ষের আইনজীবী চুপ করতে বাধ্য হন। উনি প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, আমি উত্তর ইংরেজিতে করতে পারি। আমি আমার ডিগ্রী অর্জন করতে ইংরেজিতে পড়াশোনা করেছি। কাজেই ইংরেজিতে উত্তর দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। উত্তরে আমি বলেছিলাম, ইংরেজিতে পড়াশোনা করলেও আমি ইংলিশম্যান হইনি। আমি একজন বাঙ্গালী কাজেই আমি বাংলায় উত্তর দেব। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে একজন বিচারক প্রশ্ন করলেন যে, উক্ত স্থানে কূপ খননকালে আমার ব্যক্তিগত ভুমিকা কি ছিল। উত্তরে বলেছিলাম আমি সবে মাত্র (জানুয়ারি ২০০৫) ভূতাত্ত্বিক বিভাগের দায়িত্ব গ্রহনের পর ঐ সময়ে নাইকোর কোন প্রতিনিধি আমার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ-ও করেনি এবং কোন প্রকার কারিগরি সাহায্যের প্রয়োজন মনে করেনি। একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক প্রশ্ন করেছিলেন যে, অনুসন্ধান কূপ খনন করতে আমরা অর্থাৎ বাপেক্স কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। উত্তরে বলেছিলাম, কূপ খননের জন্য আন্তর্জাতিক কোম্পানি যে যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করে থাকে বাপেক্সও একই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করে। উদাহরন দিয়ে বলেছিলাম পেট্রো বাংলা / বাপেক্স আমি ২৫ বছর এই গাস-তেল অনুসন্ধান কাজ করে আসছি। আমি শুরুতে কাজ শিখেছি রাশিয়ার টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের কাছ থেকে। অতঃপর জার্মান এডভাইসর টেকনিক্যাল গ্রুপ এবং কানাডার চ্যালেঞ্জার ড্রিলিং কোম্পানীর কাছ থেকে। বাপেক্স যখন কোন জায়গায় সাইসমিক সার্ভে করে তখন লক্ষ্য রাখি কোথাও কোন সারফেসে গ্যাস সিপেজ আছে কিনা। থাকলে ঐ গ্যাস সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কি ধরনের গ্যাস তা নিশ্চিত করে। যখন খননের স্থান চিহ্নিত করা হয় অর্থাৎ উক্ত এলাকায় কোন গ্যাস নির্গমনের স্থান আছে কিনা, থাকলে উক্ত গ্যাস পরীক্ষা করা হয়। এমনকি আশে পাশে কোথাও খাবারের পানির জন্য টিউব ওয়েল বসানোর সময় গ্যাস নির্গত হয়েছে কিনা তার তথ্য সংগ্রহ করা এবং নির্গত হলে তা পর্যালোচনা করা হয়। কাজেই গ্যাসের জন্য কূপ খননের আগে খনন কাজের জন্য সকল কারিগরী মিজারমেন্ট গ্রহন পূর্বক খনন শুরু করে। এজন্য আজ পর্যন্ত কোন ব্লো-আউটের মত দুর্ঘটনা ঘটে নাই। এ ক্ষেএে আন্তর্জাতিক নাইকো রিসোর্সেস কোম্পানি কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করে নাই। কারণ উক্ত এলাকায় ১নং কূপের আশে পাশে গ্যাস নির্গমনের আলামত ছিল। কাজেই কূপ খননের পূর্বেই যদি খননের সময়ে নিরাপত্তার জন্য যে সকল ইকুইপমেন্ট স্থাপন করার প্রযোজন ছিল তা করেনি। তাছাড়া তাদের রিগ ক্রু ভীত হয়ে কূপটিকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না করে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে সরে যাওয়ার ফলে ব্লো-আউট সংঘটিত হয়। দ্বিতীয়টি অর্থাৎ রিলিফ ওয়েল-১ খননের পূর্বে পুনরায় বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মোটামুটি ভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু খননের সময় গ্যাসের ধাক্কা অাসায়, ড্রিলিং ক্রু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন না করে সকলেই ভয়ে পালিয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয়বার ব্লো-আউট সংঘটিত হয়। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, নাইকো রিসোর্সেস কোম্পানি একটি অনভিজ্ঞ/নিম্নমানের অদক্ষ কোম্পানি। নচেৎ এরকম ড্রিলিং কোম্পানি কে দিয়ে এ ধরনের কাজ করানোর জন্য নিয়োগ দেয়া হতো না।
এখানে উল্লেখ্য, আমাকে ধারনা দেওয়া হয়েছিল যে, আমার প্রশ্ন-উওর পর্ব ঘন্টাখানেকের মত লাগতে পারে। কিন্তু যখন শেষ হয় তখন সময় দেখে বিস্মিত হই। এই ভেবে যে, আমার সাথে প্রায় চার ঘন্টার উর্দ্ধে প্রশ্ন-উত্তর পর্ব চলে। আমাদের পক্ষের বিজ্ঞ আইন পরামর্শক আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল যে, আমার কাছে তিনি যেটুকু আশা করেছিলেন তার চেয়ে অনেক কাজ হয়েছে। আশা প্রকাশ করেছিলেন যে আমরা জয়ী হব। কারন তোমার এত কারিগরী ব্যাখ্যা দেওয়ার পর প্রতিপক্ষ তেমন কোন প্রশ্ন তোমাকে করতে পারেনি। তেমনি ভাবে তুমি (অর্থাৎ আমি) যে সব তথ্য উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়েছ তা খন্ডন করার মত কোন নতুন তথ্য সংযোজন করার মত নাইকোর অবস্থান নাই। অতএব ফলাফল বাংলাদেশের দিকেই যাবে অর্থাৎ আমরা জয়ী হব।
প্রায় ৫ বছর পর সেই কাংখিত রায় জানা গেল। এজন্য আমাকে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য নির্বাচিত করায় সর্বপ্রথম কৃতজ্ঞতা জানায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী জনাব নসরুল হামিদ, সচিব বিদ্যুৎ জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের জ্বালানী বিভাগের সচিব এবং চেয়ারম্যান পেট্রোবাংলাকে।
সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাপেক্স