নিম্নমানের জ্বালানি তেল চড়া দামে কিনে ঠকছেন ক্রেতারা

দেশের সরকারি-বেসরকারি শোধনাগারগুলো থেকে সরবরাহ করা সব ধরনের জ্বালানি তেল বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মানের চেয়ে অনেক নিম্নমানের। বিপিসির চেয়ারম্যান নিজেই এ কথা স্বীকার করেছেন। ফলে অনেক বেশি দামে তেল কিনে ঠকছেন গ্রাহকেরাই।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কিছু করণীয় উল্লেখ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে কয়েকটি সুপারিশ পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেছে, বিপিসির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ভেজাল নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বিভিন্ন জ্বালানি পণ্যের মধ্যকার দাম সমন্বয় করতে হবে। আর মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বিপিসি, পেট্রোবাংলা ও বেসরকারি শোধনাগারগুলোর কাজে সমন্বয় আনতে হবে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা বলেন, দেশে সরবরাহ করা জ্বালানি তেলে বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান বজায় রাখা যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ ভেজাল। আর ভেজাল মেশানোর প্রধান কারণ বিভিন্ন জ্বালানি পণ্যের দামের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য।
বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, পেট্রল-অকটেনে ভেজাল হিসেবে মেশানো হচ্ছে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে পাওয়া কনডেনসেট (উত্তোলিত গ্যাসের সঙ্গে পাওয়া তরল জ্বালানি)। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি লিটার কনডেনসেটের দাম ২৫–২৬ টাকা হলেও দেশে সরকার নির্ধারিত দাম ৪২ টাকা। পেট্রোবাংলা এই দামে দেশের বেসরকারি শোধনাগারগুলোতে কনডেনসেট সরবরাহ করে। অপরদিকে প্রতি লিটার পেট্রল-অকটেনের দাম যথাক্রমে ৯৬ ও ৯৯ টাকা। দামের এই পার্থক্যের কারণে ভেজাল দিলে লাভ বেশি হয়।
ভেজাল মেশানো ছাড়াও পেট্রল-অকটেনের মান খারাপ। বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মানমাত্রা অনুযায়ী সেই জ্বালানিই অকটেন হিসেবে গণ্য হবে, যাতে অন্তত ৯৫ শতাংশ অকটেন অণুকণা থাকবে। আর পেট্রলে অকটেন অণুকণা থাকতে হবে অন্তত ৮৫ শতাংশ। তবে দেশের বাজারে সরবরাহ করা অকটেনে ৯০ শতাংশের কম এবং পেট্রলে ৮০ শতাংশের কম অকটেন অণুকণা রয়েছে। বিপিসির চেয়ারম্যান এই অভিযোগ স্বীকার করে এ জন্য ভেজাল মেশানোকেই দায়ী করেন।
তরল বাণিজ্যিক জ্বালানি হিসেবে দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ডিজেল। বছরে প্রায় ৫৪ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়, এর অর্ধেকই ডিজেল। ডিজেল আবার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে। পরিবহন খাতের প্রধান সংগঠন বাস-ট্রাক মালিক সমিতির কয়েকজন নেতা বলেছেন, তাঁরা যে ডিজেল ব্যবহার করেন, তার মান এতই খারাপ যে এই জ্বালানির কারণে ভালো মানের (ইউরো-৩ কিংবা ৪) ইঞ্জিনসমৃদ্ধ যানবাহন আনতে পারছেন না। তাঁরা বলেন, দেশে সরবরাহ করা ডিজেলে সালফারের পরিমাণ প্রায় ২০০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। অথচ পাশের দেশ ভারতে ব্যবহৃত ডিজেলে সালফারের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০০ পিপিএম। অতিরিক্ত সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যাপক বায়ুদূষণের কারণ। এ ছাড়া সালফারে যে পরিমাণ ‘সিটেন’ (ডিজেলের শুদ্ধতা পরিমাপক উপাদান) থাকার কথা, তা–ও থাকে না বলে পরিবহনমালিকদের অভিযোগ।
এ প্রসঙ্গে বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, ডিজেলে বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত সালফারের মাত্রা ৫০০ পিপিএম। তবে এই মানের ডিজেল সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, কুয়েত থেকে যে ডিজেল আমদানি করা হয়, তাতে সালফারের মাত্রা ২০০০ পিপিএমের বেশি। দেশেও সামান্য কিছু ডিজেল তৈরি হয়। তাতেও সালফার থাকে বিএসটিআইয়ের মানমাত্রার তুলনায় বেশিই।
বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, উচ্চ মাত্রার সালফারযুক্ত এসব ডিজেলের সঙ্গে অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা স্বল্প মাত্রার সালফারযুক্ত ডিজেল মিশিয়ে সরবরাহ করা হয়। তাতে ডিজেলে সালফারের মাত্রা ৮০০ পিপিএমের বেশি থাকে না বলে তিনি দাবি করেন। আর ডিজেলে বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত সিটেনের মাত্রা হচ্ছে কমপক্ষে ৪৫। কিন্তু দেশে সরবরাহ করা ডিজেলে এর চেয়ে সিটেন কম থাকে বলে স্বীকার করেন বিপিসির চেয়ারম্যান।
ডিজেলের পরই বেশি ব্যবহৃত তরল জ্বালানি ফার্নেস তেল। এটি মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং অল্প কিছু শিল্পে ব্যবহৃত হয়। এর মান নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ নেই। পরিমাণের দিক দিয়ে এরপরে ব্যবহৃত হয় অকটেন ও পেট্রল। এই দুটি উপাদান মূলত মধ্যম মানের গাড়িতে ব্যবহৃত হয়। বেশি দামের গাড়ির জ্বালানি হচ্ছে ডিজেল।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বন্দর থেকে সড়কপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে নেওয়ার সময় ভেজাল মেশানোর কারণে জ্বালানির মান খারাপ হচ্ছে। এটা রোধ করতে সরকার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত তেল পরিবহনের জন্য পাইপলাইন বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
জ্বালানি তেলের দাম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রায় দেড় বছর ধরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অব্যাহতভাবে কমে প্রতি ব্যারেল ২৩ ডলার পর্যন্ত নেমেছিল। কিন্তু দেশে সরকার দাম কমায়নি। আপাতত কমাবে না বলেও জাতীয় সংসদে বলেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী।
বিপিসির হিসাবে বর্তমানে প্রতি লিটার অকটেনের উৎপাদন মূল্য পড়ছে ৬৩ টাকার মতো। বিক্রি করা হচ্ছে ৯৯ টাকা। প্রতি লিটার পেট্রলের উৎপাদন খরচ ৬২ টাকা ৫০ পয়সা। বিক্রি করা হচ্ছে ৯৬ টাকা। প্রতি লিটার ডিজেলের কেনা দাম পড়ছে ৪০ টাকা ১৬ পয়সা ও কেরোসিনের কেনা দাম ৪০ টাকা ৬১ পয়সা। এই দুটি পণ্যই বিক্রি করা হচ্ছে ৬৮ টাকা। ফার্নেস তেল প্রতি লিটারের উৎপাদন খরচ পড়ছে ২৫–২৬ টাকা। বিক্রি করা হচ্ছে ৬২ টাকা। অবশ্য বিপিসির এই ব্যয়ের হিসাবে প্রকৃত বাজারদরের প্রতিফলন ঘটেনি। কারণ, বিপিসি প্রায় সব সময়ই সর্বনিম্ন বাজারদরের তুলনায় বেশি দামে জ্বালানি তেল কেনে তাদের ত্রুটিপূর্ণ ক্রয়–প্রক্রিয়ার কারণে।