শিল্প উন্নয়নে প্রধান বাধা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ: আঙ্কটাডের প্রতিবেদন
বাংলাদেশে শিল্প উন্নয়নে প্রধান বাধা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। ৫৩ ভাগ উদ্যোক্তা যথাযথ বিদ্যুৎ পান না।
ইউনাইটেড ন্যাশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) ‘এলডিসি ২০১৭ প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
বুধবার একযোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। আঙ্কটাডের পক্ষে ঢাকায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ উপলক্ষে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এবারের প্রতিবেদনের বিষয় ট্রান্সফরমিং এনার্জি এক্সেস বা রূপান্তরমুখী জ্বালানি প্রাপ্যতা। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ২০১৪ সালের বিদ্যুত্-সুবিধার তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কম্বোডিয়ার ৬ শতাংশ এবং ভূটানের ১২ ভাগ ব্যবসায়ীর জন্য এটি প্রধান সমস্যা। বাংলাদেশে বিদ্যুত্ পরিস্থিতির উন্নতি হলেও শহর-গ্রামে বিদ্যুত প্রাপ্ততার ব্যবধান অনেক বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুত্ নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশকে প্রতিবছর গড়ে ২০ থেকে ৩০ ভাগ বিদ্যুত্ সংযোগ বাড়াতে হবে। বিদ্যুত্ ব্যবহারে শহর ও গ্রামাঞ্চলের ব্যবধান অন্যান্য স্বল্পন্নোত (এলডিসি) দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। শহরাঞ্চলে ৮৪ ভাগ মানুষ বিদ্যুত্ সুবিধা পেলেও বাংলাদেশের গ্রামে মাত্র ৫১ ভাগ মানুষ বিদ্যুত্ সুবিধার আওতায় রয়েছে। ২০১৪ সালের হিসেবে বাংলাদেশে মাত্র ৬০ ভাগ মানুষ বিদ্যুত্ সুবিধার আওতায় এসেছে। দেশে জ্বালানির ৬১ ভাগ গৃহস্থলীর কাজে করা হচ্ছে। শিল্প খাতে মাত্র ২১ ভাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে সৌর বিদ্যুত্ ব্যবহারে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। ২০১৬ সালে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে এই খাতে।
মূল উপস্থাপনায় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন উল্লেখ করেন, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হতে হলে দেশের বিদ্যুত্ ও জ্বালানিখাতে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন। গৃহস্থালীর তুলনায় শিল্প ও সেবাখাতে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সুশাসনের সঙ্গে সুলভমূল্যে সবার জন্য বিদ্যুত্ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশকে শুধু সরকারি বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বেসরকারিখাত ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। তিনি বলেন, জ্বালানির ব্যবহারের সাথে নারীর ক্ষমতায়নের বিয়টিও যুক্ত। বিশেষ করে টেক্সটাইল খাতে বাংলাদেশে প্রচুর নারী কাজ করছেন। এ খাতের সম্প্রসারণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নও বাড়ানো সম্ভব। এজন্য জ্বালানির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ এসডিজি অর্জনে বিদ্যুত্খাতে এলডিসিভূক্ত দেশগুলোর জন্য ১২ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশকে কি পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে, এখানে তার উল্লেখ নেই।
প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের ৫৩ শতাংশ ব্যবসায়ী বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ প্রাপ্যতাই তাদের প্রধান সমস্যা। অথচ কম্বোডিয়ার ৬ শতাংশ এবং ভূটানের ১২ ভাগ ব্যবসায়ী এই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ১০ বছরে বাংলাদেশে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে অবকাঠামো খাতে। আর বিদ্যুত্ খাতে প্রয়োজন ১১ থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের এক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় জ্বালানি ব্যবহার মাত্র ২২২ কেজি। অথচ এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর গড় জ্বালানির ব্যবহার ৩৬৪ কেজি। এ থেকেই স্পষ্ট যে বাংলাদেশ এখনও জ্বালানি ব্যবহারে কতটা পিছিয়ে রয়েছে। তিনি বলেন, দেশে যারা বিদ্যুত্ পাচ্ছে না তাদের ৮০ ভাগ গ্রামাঞ্চলে বাস করছে, আর আফ্রিকায় এই হার মাত্র ৫০ ভাগ। বিদ্যুতের ব্যবহার করে উত্পাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভুটান, ভানুয়াতু, কম্বোডিয়ার মতো দেশ। বিদ্যুত্ ব্যবহার করে উত্পাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সরকার বিদ্যুতের জন্য যে মাস্টার প্লান করেছে তার বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্বল্প খরচে জ্বালানি নিশ্চিত করা। সরকার যে এলএনজি নির্ভর বিদ্যুত্ উত্পাদনে যাচ্ছে তাতে বিদ্যুত্ উত্পাদন খরচ অনেক বেশি হবে। তিনি বলেন, স্বল্প মেয়াদে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল এসব থেকে বেরিয়ে দীর্ঘমেয়াদী বিদু্রত্ উত্পাদনের দিকে এগুতে হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুত্ নিশ্চিত করতে এলডিসিগুলোর জন্য চারটি সুপারিশ করেছে আঙ্কটাড। এগুলো হলো শক্তিশালী বিদ্যুত্-কাঠামো ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সুশাসন ও অর্থায়ন নিশ্চিত করা, উন্নয়নের কৌশল হিসেবে জ্বালানি খাতকে প্রাধান্য দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা নেওয়া।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০৩০ সালে এসডিজি লক্ষ্য অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে, তাতে জ্বালানি খাতের বড় ভূমিকা রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশগত ভারসাম্য এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য জ্বালানি উত্পাদন হতে হবে সুলভ মূল্যে, সুশাসনের সঙ্গে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে। তিনি বলেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি জ্বালানি ব্যবহার হচ্ছে গৃহস্থলী কাজে। অথচ এটি হওয়া উচিত ছিলো শিল্পখাতে। বাংলাদেশে ২০৪১ সাল নাগাদ ৫৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে, এই পরিমাণ বিদ্যুত্ ইন্দোনেশিয়া এখনই উত্পাদন করছে।