নিরাপত্তাহীনতায় সুন্দরী
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সুন্দরী। ভাল নেই গেওয়া, গরান, গোলপাতা। অজানা আশংকায় বানর, হরিণ, কুমির। বাঘের তো গর্জনই নেই। এই নিরাপত্তাহীনতার কারণ যেমন মানুষ তেমন প্রকৃতিও। উভয় মিলে শংকায় ফেলেছে এদের।
সুন্দরবনে মিলেমিশে থাকা এসব গাছ ও প্রাণীকুলের শংকা দেখা গেল সম্প্রতি সরোজমিন ঘুরে।
খুলনা দিয়ে গেলে সুন্দরবনের শুরু করমজল থেকে। করমজল থেকে ৯০ কিলোমিটার হিরোনপয়েন্টের নীলকমল। করমজল থেকে নীলকমল এই পুরো পথ পাড়ি দিয়ে মাঝে মাঝে সুন্দরীর দেখা মিলল। অনেক দহৃর পর পর সরু সাদা ডালের মত গাছ আকাশের দিকে উঠে যেতে দেখা গেছে। যা থাকার কথা ছিল পুরো পাড় জুড়ে। এখন থেকে দশ বছর আগেও পুরো পাড় জুড়েই ছিল সুন্দরীর ঘন ছায়া।
পশর নদীকে উপজীব্য করে বনের মধ্যে যে ছোট ছোট খাল ঢুকেছে তাতে আর গা ছম ছম ভাব নেই। আগে গোলপাতা কাটতে অথবা কাঠ সংগ্রহ করতে অথবা মৌয়ালদেরকে যেতে হত অনেক সর্তকতা নিয়ে। এখন আর তা নেই। যেন স্বাভাবিক স্থলভূমি।
সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন, বনের মধ্যে পর্যটক বা অন্য কারও ঢুকতে কোন বিধি নিষেধ না থাকায় যাতায়াত দিন দিন বেড়েই চলেছে। একই সাথে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ এলাকায় গড়ে উঠেছে স্থাপনা। এর সাথে আছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানি স্তর বেড়েছে। তাতে বনের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে নোনা পানি। জোয়ার হলে বনের উচু মিঠা এলাকায় নোনা পানি ঢুকে যাচ্ছে। এতে বনের প্রাণী ও গাছের ক্ষতি হচ্ছে। এই দুই মিলিয়ে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সুন্দরবনকে কিছুটা হলেও চিন্তায় ফেলেছে।
সুন্দরবনের শেষ সীমানা থেকে দশ কিলোমিটারের মধ্যে কোন প্রকার স্থাপনা করা যাবে না বলে আইন করা হয়েছে। এই দশ কিলোমিটারকে বাফার জোন বলা হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাফার এলাকার মধ্যে বড় বড় কারখানা গড়ে উঠেছে। উঠেছে আবাসিক বসতীও। দশ কিলোমিটার তো নয়ই একেবারে বন ঘিরেই গড়ে উঠেছে বসতি ও কারখানা। আসছে নতুন নতুন কারখানা করার প্রস্তাবও। এতে পশুর নদী দিয়ে নৌ চলাচলা বেড়েই চলেছে। যদিও পশুরের প্রস্ত অনেক বেশি হওয়াতে এর বিরূপ প্রভাব কম পড়ছে বলে দাবি করছেন অনেকে।
খুলনার এক নম্বর কাষ্টম ঘাট থেকে লঞ্চে উঠে যেতে যেতে চোখে পড়বে নদীর দুপাশেই বড় বড় কারখানা। ভৌরব নদীতে শুরু হয়ে পশুর পর্যন্ত। অনেকটা সরল রেখায় সুন্দরবনের বুক চিরে পশুর চলে গেছে সাগরে। পশুরের পাড়ে বাফার এলাকার মধ্যে ঢুকলে চোখে পড়বে কারখানার সারি। উজান থেকে আরও ভেতরে গেলে আকরাম পয়েন্ট। এরদুপাড়েই ঘনবন। এখান থেকেই নদীর গভীরতা তুলনামহৃলক বেশি। সেখানে মিলবে সারি সারি বিশাল বিশাল জাহাজের মাস্তল। নোঙ্গর করা এসব জাহাজ এসেছে মালামালা নিয়ে। ফেলে আসা সারিবাধা কারখানার জন্য। ছোট ছোট জাহাজে মালামাল নামিয়ে দেয়া হচ্ছে এখান থেকে। অভিযোগ আছে এসব বড় বড় জাহাজের বর্জ্য ইচ্ছে মত ফেলা হয় নদীতে। আর সেই বর্জ্য পশুর নিজে বহর করে ফেলে দেয় সুন্দরবনের মধ্যে। কিছু চলে যায় সাগরে। এই কাজে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে জোয়ার ভাটা।
সরকারি হিসাব অনুযায়ি স্থাপনা নিষিদ্ধ ঘোষিত এলাকায় এখন পর্যন্ত ১৪৯টি শিল্প কারখানা আছে। এরমধ্যে ২৭টি অতি দূষণকারি। ৬৬টি দূষণকারি এবং ৬৫টি কারখানা অপেক্ষাকৃত কম দূষণকারি শিল্প কারখানা।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক সুবীর কুমার মণ্ডল। থাকেন সুন্দরবন শুরুর আগে পশুরের শাখা নদী মইধারা’র পাশে। তিনি সুন্দরবন নিয়ে হতাশা জানিয়ে বললেন, পশুর নদীর নাব্য কমে যাচ্ছে। এতে লবণাক্ত গাছের কোনো ক্ষতি না হলেও মিঠা পানির গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই ধারা অব্যহত থাকলে হুমকির মুখে পড়বে মিঠা পানির গাছগুলো। তিনি বলেন, আগে প্রায়ই হরিণ চোখে পড়তো। এখন হরিণও খুঁজে ফিরতে হয়। বানরও আগের মতো দেখা যায় না। করমজলের সরু খাল দিয়ে নৌকা করে মাছ ধরতে যাচ্ছিলেন চারজন। একজন পুরুষ অন্য তিনজন নারী। তাদের মধ্যে ত্রিশোর্ধ ফাতেমা জানালেন, চিংড়ীর পোনা ধরাই তাদের মহৃল উদ্দেশ্য। তবে আগের মত এখন আর মেলে না। অন্য মাছের সংখ্যাও কম।
ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে ৭৯৮তম ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের ৩০ আগষ্ট সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়াস-ইসিএ) বা বাফার জোন হিসেবে ঘোষনা দেয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের পাঁচ জেলার ১১টি উপজেলার ৬৩টি ইউনিয়নের ২৭২টি মৌজাকে ইসিএ এলাকা ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এই এলাকায় প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কাটা ও আহরণ, সবধরনের শিকার ও বন্যপ্রাণী হত্যা, বন্যপ্রাণী ধরা ও সংগ্রহ, প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস বা সৃষ্টিকারি সব ধরনের কার্যকলাপ, ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ঠ্ নষ্ট ও পরিবর্তন করতে পারে এমন সব কাজ, মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণকারী শিল্প বা প্রাতিষ্ঠান স্থাপন, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোনো প্রকার কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সরোজমিন দেখা গেছে, বাফার এলাকা নয় বনের মধ্যেও কোথাও কোথাও এসব লঙ্গন করা হচ্ছে।
পশুরের পূর্ব পাড় ধরে আগাতে থাকলে একে একে চোখে পড়বে হোলসিম সিমেন্ট, ওমেরা পেট্রোলিয়ামের এলপিজি কারখানা, দুবাই বাংলাদেশ সিমেন্ট মিলস, লুব অয়েল বেলেন্ডিং প্লান্ট, পেট্রেডেক এলপিজি, ওরিয়েন্টাল বিটুমিন ইন্ডাস্ট্রিজ, টেলিডাটা মেরিন সলিউশন, মংলা সিমেন্ট মিলস, পেট্রেমে·, বসুন্ধরা সিমেন্ট, মেঘনা সিমেন্ট, সুন্দরবন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্টেক্স·, এসকেএস এলপিজি, মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি । এগুলো সুন্দরবন থেকে একটু দূরে হলেও একেবারে নিষিদ্ধ এলাকার মধ্যে গড়ে উঠেছে পেস টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ (বিডি), টা অ্যান্ড পা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ইলেট্রিক যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী কোতোবুকি বাংলাদেশ এবং কৃত্রিম চুল প্রস্তুতকারি ওয়াইসিএল ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিজসহ অনেক কিছু।