নোনাজলে নতুন স্বপ্ন
তামান্না আক্তার:
ধনপতি সাওদাগরের দ্বিতীয় স্ত্রী খুল্লনা। তার নামে তৈরি হয় খুল্লনেশ্বরী কালী মন্দির। সেখান থেকেই খুলনা। খুলনা নামের উৎপত্তির নানা ধারণার এটি একটি। সওদাগরের স্ত্রীর নামে শিল্প নগরী। আজকের শিল্প নগরী। খুলনা ঢাকা এবং চট্টগ্রামের পরে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। খুলনা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে রূপসা এবং ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রাচীনতম নদী বন্দরগুলোর মধ্যে খুলনা অন্যতম। বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় খুলনাকে শিল্প নগরী হিসেবে ডাকা হয়। খুলনা শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলা সমুদ্র বন্দর। খুলনা জেলার দক্ষিণাংশে পৃথিবী বিখ্যাত উপকূলীয় বন সুন্দরবন। খুলনা বাগেরহাট আর সাতক্ষীরা মিলেই এই সুন্দরবন।
বরিশাল নামের মধ্যেও বণিকের সম্পর্ক আছে। পর্তুগীজ বণিকর প্রেমের কাহিনী জড়িত। অনেক মতভেদের মত এটাও একটা। বড় বড় শালগাছের কারণে (বড়+শাল)= বরিশাল; পর্তুগীজ বণিক বেরী ও শেলীর প্রেম কাহিনী থেকে বরিশাল; বড় বড় লবণের গোলার জন্য বরিশাল ইত্যাদি। গিরদে বন্দরে (গ্রেট বন্দর) ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবণের চৌকি ছিল। এ জেলার লবণের বড় বড় চৌকি ও বড় বড় দানার জন্য ইংরেজ এবং পর্তুগীজ বণিকরা এ অঞ্চলকে ‘‘বরিসল্ট’’ বলত। এ বরিসল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়েছে বলেও অনেকের ধারণা।
গল্প দুটো এজন্য বলা যে বরিশাল আর খুলনা দক্ষিণের বড় এই দুই শহর ব্যবসায়ের সাথে দীর্ঘ দিনের সম্পর্কে জড়িত। সমুদ্র উপকূল হওয়ায় বাণিজ্যের বসতি। এই দুই জেলার নাম করণেও হয়তো তার ছোঁয়া আছে। কিন্তু মূল ভূখণ্ডের সাথে যোগাযোগ না থাকায় কালক্রমে তা আর মূল স্রোতে ঠাঁই করতে পারেনি। সমুদ্রের নোনা জলের কর্মঠ মানুষ সুযোগ সুবিধার অভাবে পিছিয়ে পড়েছে।
এখন সুযোগ এসেছে। সুযোগ তৈরি হয়েছে, পুরো দেশের সাথে সরাসরি, বাধাহীন যুক্ত হওয়ার। আর এতেই ঐ পুরো অঞ্চল ঘুরে দাঁড়াবে।
পদ্মা সেতু ঘিরে নানা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে দক্ষিণের নোনাজলে ভেজা মানুষ। দ্রুত যাতায়াতের পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করছেন অনেকে।
চিংড়ী বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন একটি আলোচ্য নাম। বিভিন্ন সুস্বাদু মাছ আছে ঘের জুড়ে। ধান, রবি শষ্য সবজিতে ভরা দক্ষিণাঞ্চল। উর্বর মাটি। কর্মঠ এলাকার মানুষ। তাই প্রণোদনা পেলে খান জাহান আলীর এলাকার মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে বেশি দিন সময় নেবে বলে মনে হয় না।
পদ্মা সেতুর আরও সুফল পেতে দক্ষিণে নতুন নতুন শিল্প করতে হবে। বিশেষ করে পোশাক শিল্প ঐ অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। বিনিয়োগ করা যেতে পারে পর্যটনে। দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। যাতে করে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। এতে কর্মসংস্থান হবে।
অনেক খাতেই বিনিয়োগ হতে পারে। কুয়াকাটায় আরও বিনিয়োগ করতে হবে। কক্সবাজারের সাথে কুয়াকাটায়ও যাতে পর্যটন আরও বাড়ে সে দিকে বিনিয়োগ করতে হবে।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। এই একটি সেতুতেই এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। মোংলা ও পায়রা বন্দরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে।
বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হবে। এটা অর্থনীতিকে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য ও পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই অবদান রাখবে এই সেতু।
পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে অর্থনীতিতে নানা ধরণের অবদান রাখবে এই সেতু। সেতু তৈরিতে যা খরচ হয়েছে তার প্রায় তিনগুণ অবদান রাখবে এই সেতু। জিডিপিতে অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে।
পদ্মা সেতু আমাদের গর্বের। এটা হবে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। আমাদের ভৌগোলিক যে বিভাজন ছিল, তাতে সংযোজন স্থাপন হবে। একটা একীভূত অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হবে।
বিনিয়োগ, বিতরণ ও বিপণনে সাশ্রয় হবে। আর সেই সাশ্রয়ের অর্থ নতুন করে বিনিয়োগ হবে। নতুন যে সড়ক করা হয়েছে তার দু পাশে এরইমধ্যে নানা শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। এই বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থান অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্য সহজে ও অল্প খরচে ভোক্তার কাছে যাবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিনিয়োগ, শিল্প পার্ক ও পর্যটন খাতের ব্যাপক উন্নয়নে নজর দিতে হবে।
পদ্মা সেতুর ফলে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় চাপ কমছে। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুতেও চাপ কমবে। সুতরাং পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আশীর্বাদ নয়, দেশের উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম সব দিকে এর প্রভাব পড়বে।
ইতিমধ্যে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারিভাবে বিনিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগ সফল করতে হবে। সরকার ও বিশ্বব্যাংক ১০ বছর মেয়াদি ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের কর্মসূচি নিয়েছে। পদ্মাসেতুর কারণে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য গ্রামীণ যোগাযোগ তথা সঠিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ও বিশ্বব্যাংক ২০৩০ সাল পর্যন্ত কর্মসূচি নিয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক ৫০ কোটি ডলারের একটি ঋণ চুক্তি করেছে। এই ঋণের আওতায় যশোর থেকে ঝিনাইদহ ৪৮ কিলোমিটার দুই লেনের সড়ক চার লেন হবে। পুরো কর্মসূচির আওতায় সিরাজগঞ্জের হাটিকামরুল থেকে সাতক্ষীরার ভোমরা পর্যন্ত ২৬০ কিলোমিটার বর্তমানের দুই লেনের সড়ক চার লেন করা হবে। এ ছাড়া ৬০০ কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা গ্রামীণ হাটবাজারের সাথে যোগ করে সড়ক করা হবে।
এতে ঐ অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ উপকৃত হবে।
দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়নের অবস্থা তেমন উন্নত ও যুগোপযোগী নয়। অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ পেছনেই পড়ে আছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল। এই অঞ্চলে কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় বটে, কিন্তু যোগাযোগ সমস্যার কারণে দরিদ্র কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকেু বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। পদ্মা সেতু এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাবে। তাই আমরা বলতে পারি, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনে যেমন ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে কৃষকরা আরও অধিক হারে উৎপাদন করবেন। পাশাপাশি এ সেতুকে কেন্দ্র করে নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে সচল রাখবে।
২০৪১ সালে যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন তা হইতো এই সেতুর মাধ্যমেই, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মাধ্যমে আরও এগিয়ে যাবে।