পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও বড় সমুদ্র অঞ্চল পেয়েছে বাংলাদেশ

জাতিসংঘ ট্রাইব্যুনালের যুগান্তকারী রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কাছে ভারত পশ্চিমবঙ্গের আয়তনের চেয়েও বড় সমুদ্র অঞ্চল হারিয়েছে। এই সমুদ্র এলাকা নিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় থেকেই দুই দেশের বিরোধ চলছিল। নয়াদিল্লি যে অঞ্চলকে বিরোধপূর্ণ মনে করেছিল এবং যেটা ভারতের অধীনেই থাকা উচিত, বঙ্গোপসাগরের সেই এক লাখ ৭২ হাজার ২২০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে এক লাখ ৬ হাজার ৬০৩ বর্গকিলোমিটার জাতিসংঘের স্থায়ী সালিশি আদালতের রায়ে বাংলাদেশ পেয়ে গেছে। ওই আদালতের ভারতীয় প্রতিনিধি রায়ের ব্যাপারে অন্য বিচারকদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেও সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের ভোটে টেকেনি। তবে সরকারিভাবে দুই দেশই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিন বলেছেন, ভারত ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়ের সুরাহা হওয়ায় দুই দেশের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সদিচ্ছা আরও জোরদার হবে।

তবে এই রায়ের ফলে সমুদ্রের যে এলাকা ভারত বাংলাদেশের কাছে হারাল সেখানে আর ভারতীয় জেলেরা যাওয়ার সুযোগ পাবে না। ভারতের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস করপোরেশন ওই এলাকার যেসব স্থানে তেল ও গ্যাসের মজুদ রয়েছে বলে চিহ্নিত করেছিল, সেখান থেকে আর তেল ও গ্যাস সম্পদ আহরণ করতে পারবে না।
পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ রায় প্রদানের ক্ষেত্রে যেসব যুক্তি গ্রহণ করে, সেটাও ভারতের পক্ষে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের জন্য বিব্রতকর। এ ছাড়া রয়েছে পূর্ব উপকূলীয় রাজ্য সরকারগুলোর দিক থেকে বিরোধিতার শঙ্কা। পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকদের জন্য সেটাও কম উদ্বেগের নয়।
ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন একজন পদস্থ ভারতীয় কর্মকর্তা দ্য টেলিগ্রাফকে বলেন, সত্য বলতে কি, এ রায় ভারতের জন্য ভালো নয়। বাংলাদেশকে যে এলাকা দেওয়া হয়েছে, সেটা আমাদের বিবেচনায় অযৌক্তিক। তাদের সিদ্ধান্তের পক্ষে অবাস্তব যুক্তি দেয়া হয়েছে। সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর মাধ্যমে দুটি প্রতিবেশী সার্বভৌম দেশের সমুদ্র এলাকা সুনির্দিষ্ট করা হয়থ উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল (এক নটিক্যাল মাইল ১৮৫২ মিটার) এবং সমুদ্রে আরও ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত নিজস্ব অর্থনৈতিক এলাকা।
যদিও কোনো দেশের এই নিজস্ব অর্থনৈতিক এলাকার ওপর টেরিটরিয়াল সভরেন্টি থাকে না এবং সেখানে যে কোনো দেশের জাহাজ অবাধে চলাচল করতে পারে। তবে যে দেশটির এই নিজস্ব অর্থনৈতিক এলাকা থাকে, তারা সেখানে অর্থনৈতিক সম্পদ অনুসন্ধান, আহরণ ও ব্যবহারের পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করে। বঙ্গোপসাগরে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ওএনজিসি ২০০৫ সাল থেকে তেল ও গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধান করছে।
কয়েক দফা অসফল আলোচনার পর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে জাতিসংঘ আরবিট্রেশন কোর্টের দ্বারস্থ হয়। ভারতও তাদের কার্যক্রমে অংশ নিতে রাজি হয় এবং পাঁচ সদস্যের বিচারক প্যানেলে শুনানির জন্য প্রেমরাজা শ্রীনিবাস রাওকে মনোনীত করে। বাংলাদেশ মনোনীত করে ঘানার টমাস এ মেনশাহকে। ভারতের পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে যুক্তি উপস্থাপন করেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল জিই বাহানভাতি।
ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে ভারত জোর দিয়ে বলে যে, কেবল বাংলাদেশ ও বাংলার দক্ষিণাঞ্চলকে সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করার জন্য বিবেচনায় নিতে হবে। এ এলাকার আয়তন ১ লাখ ৭২ হাজার ২২০ বর্গকিলোমিটার, যা বাংলার আয়তন ৮৮ হাজার ৭৫২ বর্গকিলোমিটারের দ্বিগুণ।
অপরপক্ষে বাংলাদেশ দাবি করে যে, উড়িষ্যা ও অন্ধ্রপ্রদেশের সীমানা সংলগ্ন সমুদ্র এলাকাকেও বিতর্কিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। জাতিসংঘ কেবল বাংলাদেশের দাবির যৌক্তিকতাকেই মেনে নেয়নি, বরং আরও নতুন এলাকা এর সঙ্গে যুক্ত করে। ফলে বিতর্কিত এলাকা দাঁড়ায় ৪ লাখ ৬ হাজার ৮৩৩ বর্গকিলোমিটার, যা উত্তর প্রদেশ, বাংলা ও আসামের আয়তনের সমান। এ ধরনের সংজ্ঞার কারণে বিতর্কিত জলসীমা উড়িষ্যা উপকূল থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তমের কাছে স্যান্ডি পয়েন্টের কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ভারতের প্রতিনিধি এতে আপত্তি উত্থাপন করেন, কিন্তু ভোটে হেরে যান।
শুনানিতে ভারতের কেবল সামান্য সান্ত্বনার জয়, সুন্দরবনের দক্ষিণে অগভীর সমুদ্র এলাকা থেকে সীমানা চিহ্নিত করার সূচনাবিন্দু ধরা। এ জয়ের কারণে ভারত নিউমুর বা দক্ষিণ তালপট্টি নামে অতি ক্ষুদ্র একটি দ্বীপের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করেছে। তবে উপগ্রহ চিত্র থেকে দেখা যায় যে, এ এলাকাটি ইতিমধ্যেই সমুদ্রে তলিয়ে গেছে।
নয়াদিল্লি আরও একটি বড় লড়াইয়ে হেরেছে। বাংলাদেশ দাবি করে যে, বিচারকরা কম্পাস ও পেন্সিল দিয়ে ‘১৮০ ডিগ্রি নীতিমালা’ অনুসরণ করেন। অন্যদিকে ভারত এর বিরোধিতা করে। কারণ এর ফলে বাংলাদেশ যা ন্যায্য তার চেয়ে বেশি সমুদ্র এলাকা পেয়ে যাবে। ভারত সমদূরত্ব নীতিমালা অনুসরণের দাবি করে। ট্রাইব্যুনাল কিছু ক্ষেত্রে ভারতের মত সমর্থন করে, কিন্তু তারা এটা প্রয়োগ করেছে কেবল উপকূলের কাছের এলাকার জন্য। বিতর্কিত বাদবাকি এলাকার ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের মতকেই সমর্থন দেয়। তারা বাংলাদেশের প্রস্তাব থেকে অতি সামান্য সরে ১৭৭ ডিগ্রি কোণ অনুসরণ করে দাগ টানে।
রায়ের মাধ্যমে ভারত পেয়েছে ৩ লাখ ২২০ বর্গকিলোমিটার এবং বাংলাদেশ ১ লাখ ৬ হাজার ৬১৩ বর্গকিলোমিটার, যা বাংলাদেশের প্রায় তিন গুণ, এ ধরনের ব্যাখ্যা বিভ্রান্তিকর। কারণ এতে এমন সমুদ্র এলাকা অন্তর্ভুক্ত করে দেখানো হয়েছে, যা কখনও বিতর্কিত ছিল না।
বাংলাদেশের জন্য এটা হচ্ছে অল্প সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয় বড় জয়। তারা ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত মামলায় জয়ী হয়েছে।