পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র: অনন্য দৃষ্টান্ত

প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম:

বিদ্যুতের পরিকল্পিত এবং যথাযথ ব্যবহার একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে বিদ্যুৎ ছাড়া ভাবা যায় না। নগরায়ন, শিল্পায়ন ও দেশের জনসংখ্যার সাথে সমতা রক্ষা করে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে।
আর এই উৎপাদন বাড়াতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যতম ভূমিকা পালন করছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়েছে এর কাজ। এতে যে অর্থ খরচ হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে কম খরচ হয়েছে। দেশে এখ নপর্যন্ত সবচেয়ে বড় অবকাঠামো এটি।
বড় প্রকল্পে অর্থ জোগাড় করতে বেশি সময় লাগে। কিন্তু এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে অল্প সময়ে হয়েছে, মাত্র একমাসে। জমি অধিগ্রহণও কাজ পিছিয়ে দেয়। কিন্তু পায়রার জন্য এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে মাত্র আট মাসে। চারদিকে কাজ এক সাথে হয়েছে। তাই নির্ধারিত সময়ের আগেই উৎপাদনে এল এই কেন্দ্র।
দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র করার পরিকল্পনা করা হয়। তারই আলোকে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (নওপাজেকো) এবং চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সিএমসি যৌথভাবে সমান অংশিদারিত্বে বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে সমঝোতা করে। সেটা ২০১৪ সালের ঘটনা। যৌথভাবে গঠন করা হয় বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানী (প্রা.) লিমিটেড। তারপর অজানা বিষয় নিয়ে নতুন উদ্যোগে পথ চলা শুরু। কারণ, এতবড় আর আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র করার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের কারও আগে ছিল না। এটাই প্রথম।
বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানী (প্রা.) লিমিটেড ১৩২০ মেগাওয়াট এর দুইটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করে। কোম্পানি গঠন থেকে শুরু করে অন্য সবকিছু শেষ করে কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। আর চার বছরের মাথায় এই বিশাল যজ্ঞের ফল পাওয়া শুরু। জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয় আমদানি করা কয়লা থেকে, দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন। সেই সাথে বাংলাদেশ পৃথিবীতে ১৩তম দেশ হিসেবে আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহারকারি দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে তা পরিবেশ বান্ধব।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে ২৪৮ কোটি ডলার খরচ হচ্ছে। এখানে প্রতিবছর প্রায় ৩৫ লাখ টন কয়লা প্রয়োজন হবে। কয়লা সবসময় ঢাকা থাকবে। কোন ছাই উড়বে না। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশিকার চেয়ে কম থাকবে সক্স (ঝঙী) ও নক্স (ঘঙী)।
এখানে পাওয়ার হাউস এবং অক্সিলিয়ারি, সুইচ ইয়ার্ড, জেটি, কুলিং টাওয়ার,নদীর পানির রিসার্ভার, ডিসালফারাইজেশন প্ল্যান্ট, ডিমিনারালাইজেশন প্ল্যান্ট, ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট, সার্কুলেটিং ওয়াটার পাম্প হাউস, এফজিডি, কোল হ্যান্ডলিং সিস্টেম (কনভেয়ার বেল্ট এবং স্টক পাইল), এ্যাশ হ্যান্ডলিং ও ডিসপোজাল সিস্টেম, ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং রেসিডেন্সিয়াল টাউনশিপ রয়েছে।
পুনর্বাসন
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রর জমি অধিগ্রহণে ১৩০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছিল। ৮২টি পরিবারকে আট শতক জমিতে ১ হাজার ২০০শ’ বর্গফুট আয়তনের বাড়ি বানিয়ে দেয়া হয়েছে। এই পরিবারগুলো ২০ শতকের বেশি জমির মালিক ছিল। আর যারা ২০ শতকের কম জমিতে বসবাস করত এমন ৪৮টি পরিবারকে তাদের ছয় শতক জমিতে এক হাজার বর্গফুট আয়তনের বাড়ি বানিয়ে দেয়া হয়েছে। সব বাড়ি এল আকৃতির দক্ষিণ মুখো। এ ছাড়াও আধুনিক আবাসনের সকল সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য মসজিদ, স্বাস্থ্য ক্লিনিক, টেকনিক্যাল স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, খেলার মাঠ ইত্যাদির সমন্বয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ‘স্বপ্নের ঠিকানা’। পুনর্বাসন কেন্দ্রটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন।
জিডিপিতে অবদান
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন বা বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ার সাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছে। তাই এটি জ্বালানি সাশ্রয়ী। ফলে কম খরচে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল উন্নয়নে বরাবরই পিছিয়ে থাকার কারণে, দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি দীর্ঘ দিন থেকেই ব্যহত হচ্ছিল। পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠছে নতুন অবকাঠামো। তৈরি হচ্ছে শিল্প-কারখানা, কর্মসংস্থানের সুযোগ। বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের আয়। এছাড়া, এই প্রকল্পের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে।
আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন
পিছিয়ে পড়া এই জনপদে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে বদলে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থান, বেড়েছে মানুষের আয়, ক্রয় ক্ষমতা। বিসিপিসিএল এর উদ্যোগে একটি টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের কারিগরি জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশেপাশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে যে মানুষগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন, তারা আজ আধুনিকতা আর উন্নয়নের স্বপ্নে এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে।
পায়রা বন্দরকে সচল রাখবে
পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রর আশপাশে গড়ে ওঠা অন্যান্য বড় প্রকল্পের জন্যও আশীবার্দ। পায়রা সমুদ্র বন্দর তারমধ্যে একটি। এই বন্দরের মূল কার্যক্রম এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরেই চলছে। এ পর্যন্ত পায়রা বন্দর থেকে খালাস হয়েছে ১৩০টি কয়লাবাহি জাহাজ। যা পায়রা সমুদ্র বন্দরের মূল আয়ের উৎস। বিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরে প্রায় ৩৫ লাখ টন কয়লা লাগবে। যা পরিবহনে বছরে প্রায় ১৭০টি জাহাজ আসবে। এছাড়াও প্রকল্পের মালামাল, ঠিকাদারের নির্মাণ সামগ্রী ইত্যাদি সাধারণত নৌ পথে পরিবহন করা হয়। যা পায়রা বন্দরকে সচল রেখেছে। সামগ্রিকভাবে পায়রা বন্দর সচল রাখবে। এই বন্দরের আয় বাড়বে। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রর জন্য বন্দরের পরিচিতিও বাড়বে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ধানখালী থেকে দেশে ছড়িয়ে পড়বে এই আলো। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাখবে অগ্রণি ভূমিকা।

 

প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম

লেখক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ-চায়না পাোয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড